মৃত্যুপথ (Based on Actual Characters)

“দা প্রিপারেশন প্রসেস”

প্রতিদিন অফিসের একঘেয়ে কাজগুলো কখনও কখনও খুব বিরক্তিকর একটা সিনেমা দেখার চাইতেও জঘন্য মনে হয়। তার উপর যদি হঠাৎ কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় প্রতিদিন ১২ ঘণ্টার বেশি সময় অফিসে কাটানোর প্রয়োজন পড়ে, কর্মচারীদের নাভিশ্বাস অবস্থা সৃষ্টি হওয়াটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। সরকারী অফিসের বড় কর্মকর্তাদের দেখলে মাহতাবের খুব হিংসে হয়। ৯ টার ডিউটি শুরু করা যায় ১০ টায় বা আরও পরে। যতই কাজের চাপ থাকুক বিকেল ৫টা বাজতেই বাড়ির পথে রওনা দেয়া যায়। মাঝের সময়টাতে ছোট খাট একটা ঘুম দিয়ে নিলেই বা ক্ষতি কি? কেউ কিচ্ছু বলার নেই।

ট্যাক্সিটা হঠাৎ হাইওয়ে ছেড়ে ছোট রাস্তায় ঢুকে পড়লে হাফ ছেড়ে বাঁচল মাহতাব। রাস্তার দুধারে পরিচিত দৃশ্য। অফিস থেকে বাড়ির ফেরার এই মুহূর্তটুকু তার কাছে স্বর্গ হাতে পাওয়ার মত। আজও ফিরতে ফিরতে রাত ১০ টা বেজে যাবে। রিশান নিশ্চয়ই ঘুমই পড়েছে। বেচারা একদিনও বাবার দেখা পায়না। সপ্তাহে একটা ছুটির দিন না থাকলে হয়ত নিজের বাবা কে চিনতেই পারত না সে! বেসরকারি ফার্মের চাকুরীতে কেবল একটাই সুবিধা পেয়েছে মাহতাব। মাস শেষে ভাল মাইনে আসে পকেটে। এছাড়া তার কর্মজীবনে আনন্দ করার মত উপলক্ষ খুব বেশি নেই।

বাড়ির গলি-মুখ দেখা গেল। কিন্তু ড্রাইভার হুশ করে সেটা পেড়িয়ে গেল। কি ব্যাপার? লোকটা কি রাস্তা হারিয়ে ফেলল? সম্ভবত ঘুরপথে যাচ্ছে। সেটাই ভাল। ইদানীং এইদিকটাতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বেড়ে গেছে। শর্টকাট গলি-চিপা ধরে না যাওয়াই উত্তম। বাসাটা পরিবর্তন করা জরুরী হয়ে পড়েছে, সময়ই হচ্ছেনা বাসা খোঁজার!

কিন্তু ড্রাইভার যখন পরের বড় গলিটাও পেড়িয়ে গেল তখন মাহতাবের সন্দেহ দৃঢ় হল। ড্রাইভার মনে হচ্ছে বাসা চেনেনা। প্রশ্ন করল ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে, “কি ব্যাপার ভাই? যাচ্ছেন কোথায়? রাস্তা চেনেন না?”

ড্রাইভার জবাব দিলনা, গাড়ির ড্যাশ বোর্ড খুলল কিছু একটা বের করল। মাহতাব দেখল ড্রাইভার মুখে একটা মাস্ক লাগাচ্ছে। বিপদের গন্ধ পেল সে কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ড্রাইভিং সিটের পাশে ফেলে রাখা একটা টিউবের মুখ খুলে দিতেই বক বক করে ধোঁয়ায় ভরে গেল গাড়ির ভেতরটা। সেই ধোঁয়া নাকে মুখে প্রবেশ করতেই বার কয়েক কেশে উঠল মাহতাব। কয়েক সেকেন্ড বাদেই তার দেহটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেল গাড়ির ব্যাকসিটে।

ট্যাক্সিটা আবার প্রধান সড়কে তুলে আনল ড্রাইভার। শহরের বাইরে অনেক দূর যেতে হবে তাকে। এই সময় মাহতাব সজ্ঞান থাকলে দেখতে পেত ড্রাইভারের ঠোঁটের কোনে অদ্ভুত এক টুকরো হাসি ফুটে আছে!

***

মুয়াজ্জিনের দরাজ কণ্ঠের মাগরিবের আযান ভেসে আসতেই মোড়ের চায়ের দোকানে আড্ডার আসর বসায় একদল চাকুরী সন্ধানী যুবক। তবে আড্ডাটা মূলত জমে ওঠে রাত আটটার পর। এলাকার বেকার সমাজের সভাপতি গফুর ভাই এই সময় চলে আসেন। গফুর ভাই যদিও পুরোপুরি বেকার নন, ছোট খাট একটা ফোন ফ্যাক্সের দোকান চালায়; তবুও তিনি নিজেকে বেকার ঘোষণা করেছেন এবং সব সময় এভাবেই থাকতে চান।

গফুর ভাইকে বেকার সমাজের সভাপতি করার পিছনে প্রধান কারণ এই আড্ডার আসরের চা- সিগারেটের তিনিই একমাত্র পৃষ্ঠপোষক। উনি নিজেই অবশ্য সবচেয়ে বড় সিগারেট-খোর। ক্রমাগত ধোঁয়া টানার ফাঁকে অনর্গল কথা বলেন আর খুব হাসেন।
আরিফকেও ঠিক সেই অর্থে বেকার বলা যাবেনা। মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে কেবল। অনার্স শেষে কিছুদিন চাকরীর খোঁজে ছুটেছে, কুল কিনারা না হওয়ায় শেষে ঠিক করেছে মাস্টার্স কমপ্লিট করে ফেলবে। ঘণ্টার কাটা ১০ এর ঘরে পৌঁছে জম্পেশ এই আড্ডার পরিসমাপ্তি টানে। একে একে সবাই যে যার বাড়ির দিকে রওনা করে।

ঘড়িতে সময় বলছে ১০টা ১৫ মিনিট। প্রমাদ গুনল আরিফ। আজও বাড়ি ফিরতেই একগাদা গালাগাল শুনতে হবে বাবার মুখে। “অপদার্থ”, “ননসেন্স”, “উজবুক” শব্দ গুলো খুব বেশি ব্যাবহার হবে তখন। বাবা ইদানীং খুব খিটখিটে স্বভাবের হয়ে গেছেন। পান থেকে চুল খসলেও আর রক্ষা নেই। বার্ধক্য মানুষের সব চেয়ে বড় শত্রু।

গলির মাথায় একটা পিক-আপ ভ্যান পার্ক করে রাখা আছে। অন্ধকার কোনে দাঁড়িয়ে একটা লোক সিগারেট ফুঁকছে। এদিকে লোকটাকে আগে কখনও দেখেনি আরিফ। হয়ত এদিকে নতুন উঠেছে। অথবা হয়ত বউ এর কাছ থেকে লুকনোর জন্য বাসা থেকে দূরে এসে সিগারেট ধরিয়েছে, হয়ত অন্য কিছু... বেকার মানুষের এসব নিয়ে চিন্তা করার কি দরকার?

আরিফের বাসা গলির শেষ মাথায়। কিছুদূর এগিয়ে আসতেই তার মনে হল পেছন পেছন কেউ একজন আসছে! ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করল সে। ঐ লোকটাই! এখনো সিগারেট ফুঁকছে। ছিনতাইকারী নয়ত? হাঁটার গতি বাড়াল আরিফ। পেছনে পায়ের আওয়াজে বুঝল লোকটাও জোরে হাটা ধরেছে! দৌড় দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল আরিফ, বাসা তো কাছেই তার।
কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে একটু দেরি হয়ে গেল। হঠাৎ পেছন থেকে শক্ত কিছু একটা দিয়ে তার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করা হল। আরিফ হাঁটু ভাজ হয়ে পড়ে গেল। কপালটা ভীষণভাবে ঠুকে গেল রাস্তার পিচে। পরক্ষনেই জ্ঞান হারাল সে।

লোকটা ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। আরিফের নিস্তেজ দেহটা কাঁধে তুলে। গলির মাথায় পিক আপ ভ্যানটা সে নিজেই দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আপাতত তার গন্তব্য অতটুকুই। তারপর পাড়ি দিতে হবে অনেক দূরের পথ!

পূর্ব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে!

***

“দা গেইম বিগিনস্”

ঘরের কোনায় একটা অল্প পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। তার আলো সমস্ত ঘরকে আলোকিত করার জন্য যথেষ্ট নয়। আধো অন্ধকার-আধো আলো মিলিয়ে সমস্ত ঘর জুড়ে এক ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। জানালা-বিহীন ঘর, একটি মাত্র দরজা বাইরে থেকে আটকানো। আলো বাতাস চলাচলের জন্য একটা ভেন্টিলেটর আছে কিন্তু তাতেও বাঁধা বসিয়েছে মাকড়শার জাল।

ঘরের ঠিক মাঝখানে অযত্নে ফেলে রাখা একটি পুরনো ঘুণে ধরা কাঠের টেবিল। তার দুপাশে মুখোমুখি বসানো রয়েছে দুটো হাতল বিশিষ্ট চেয়ার। দুজন মানুষ অচেতন হয়ে পড়ে আছে, তাদের হাত পা গুলো চেয়ার সাথে বেশ শক্ত করে বাঁধা। দু প্রান্তে দুটো দৈনিক পত্রিকার পাতা থেকে কাটা অংশ পড়ে আছে আর টেবিলের ঠিক মাঝ বরাবর নগ্ন হাসি হাসছে একটা পয়েন্ট থ্রি টু ক্যালিবারের ওয়ালথার পি পি কে পিস্তল, যেন প্রমাণ করতে এই ঘরের ভেতরের প্রতিটি জীব ও জড়বস্তু অপেক্ষা তার ক্ষমতা অধিক।

এক জন অচেতন মানুষ ধীরে ধীরে চেতনা ফিরে পাচ্ছে। তার মুখ থেকে গোঙ্গানির শব্দ শুনেই বোধহয় অপরজনও সজাগ হয়ে উঠল। দুজনের কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুনতে পেল অদৃশ্য কেউ একজন বলছে, “স্বাগতম! স্বাগতম! মৃত্যুপথ খেলায় অংশ নেওয়ায় আপনাদের জানাই অশেষ ধন্যবাদ”।
শব্দের উৎসের খোঁজে ঘরের চারিদিকে উদভ্রান্তের মত দৃষ্টি বোলাল দুজনেই। ঘরের এক কোনে ছোট একটা সাউন্ড স্পিকার নজরে এলো। দুজনের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটি বলে উঠল, “কে আপনি? কি চান? কেন ধরে এনেছেন আমাকে?”
অচেনা সেই কণ্ঠ বলল, “ধীরে মাহতাব সাহেব! ধীরে! সবই বলব আপনাদের। একটু সুস্থির হয়ে বসুন”।

সুস্থির হওয়ার উপায় নেই মাহতাবের। কপালের দুপাশে প্রচণ্ড রকমের ব্যথা অনুভব করছে। সম্মুখে বসে থাকা লোকটির দিকে নজর দিল। বয়সে ছেলেটা তার চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট হবে হয়ত। চোখে মুখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। কপালের একধার বেঢপ ভাবে ফুলে আছে। ঘটনার আকস্মিকতায় দুজনেই তারা স্বাভাবিক চিন্তা শক্তি হারিয়ে ফেলেছে!

অচেনা কণ্ঠ বলছে, “মাহতাব চৌধুরী এবং আরিফ হোসেন, আপনারা দুজনেই আমাদের এক লাইভ গেইমশো তে অংশ গ্রহণকারী। এই খেলার নাম মৃত্যুপথ, চলছে সিজন সেভেন। আমি আপনাদের হোস্ট, সপ্তম মৃত্যুপথ পরিচালনাকারী। আমাকে আপনারা চাইলে মৃত্যুদূত বলেও ডাকতে পারেন ...”
দুজনকে দেখলে মনে হবে তারা বোধহয় একটা ঘোরের মধ্যে আছে। ব্যাপারটা যে স্বপ্ন নয়, সত্যিই ঘটছে সেটা এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না কেউ।

অচেনা কণ্ঠ কিন্তু থেমে নেই, “... আমাদের গেমের স্লোগান হচ্ছে- কিল অর বি কিল্ড। খেলায় রয়েছে মোট পাঁচটি রাউন্ড। প্রতি রাউন্ডে আপনার সামনে দুটো অপশন খোলা থাকবে। আপনাকে হয় একজন মানুষকে হত্যা করতে হবে, নইলে আত্মহত্যা করতে হবে। আত্মহত্যা করলে আপনি খুব সহজেই এই খেলা থেকে মুক্তি পেয়ে যাবেন। আর যদি হত্যা করতে পারেন তাহলে আপনি পরের রাউন্ড খেলার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। এভাবে চার রাউন্ডে জয়লাভ করলে আপনাকে আমাদের মৃত্যুপথ খেলার সপ্তম সিজনের চূড়ান্ত বিজয়ী বলে ঘোষণা দেওয়া হবে এবং আপনার জন্য থাকবে বিশেষ পুরষ্কার!”

কণ্ঠের অস্থিরতাটুকু ঢেকে রাখতে ব্যর্থ হল আরিফ, “কিন্তু আ... আমাকে কেন এখানে ধরে আনা হয়েছে? আ... আমি তো এই খেলায় অংশ নিতে চাইনি!”
তার সাথে সুর মেলাল মাহতাব, “হ্যা! আমিও এই খেলা খেলতে চাইনি! আপনার কি অধিকার আছে আমাদেরকে জোর করে ধরে এনে খেলায় অংশ নিতে বাধ্য করার?”
“হা হা হা...” অট্টহাসির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কারো হাসির আওয়াজ এমন ভয়ংকর হতে পারে সেটা নিজ কানে না শুনলে বিশ্বাস করা যায়না। যেমন হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল তেমনি আচমকা থেমে গেল মৃত্যুদূতের হাসি। “আমাদের এই গেমে অংশ নিতে হলে একটি বিশেষ অপরাধ করতে করতে হয়। তবে শুধু অপরাধ করলেই হবেনা, আইনের ফাঁক গলে পালিয়ে আসতে হবে। আপনারা উভয়ই সেই কাজটি করে আসতে পেরেছেন সফলভাবে”।
“কি করেছি আমরা?”
“আপনাদের দুজনের সামনে দুটো পত্রিকার কাটা অংশ পড়ে আছে। খেয়াল করলে দেখবেন আপনাদের ডান হাত বেঁধে রাখা হয়নি। পত্রিকার খবরটি পড়ে দেখুন”।
দুজনেই যার যার সামনে ফেলে রাখা পত্রিকার কাটা অংশটুকু হাতে নিল।

আসুন দর্শক, আমরা প্রথমে আরিফের হাতে ধরে রাখা পত্রিকার খবরটিতে নজর দেই-

বন্ধুদের হাতে বন্ধু খুন

যশোরে বন্ধুদের ছুরির আঘাতে মারা গেলো শরিফুল ইসলাম শরিফ নামে আরেক বন্ধু। রোববার ছুরির আঘাতে মারাত্মক জখম হলে তাকে যশোর মেডিকেলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুপুর দেড়টার দিকে তার মৃত্যু হয়। নিহত শরিফ যশোর শিক্ষাবোর্ড মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণীর বাণিজ্য বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র।এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে কয়েকজনকে খুঁজছে পুলিশ।
স্থানীয় ও হাসপাতাল সূত্র জানায়, রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শরিফের বাড়ির সামনে তার বন্ধু জুয়েল, আরিফ ও নাজমুলের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে বন্ধুরা তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করলে শরিফ মারাত্মকভাবে আহত হয়। যশোর মেডিকেলে ভর্তির পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেলা দেড়টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
যশোর কোতোয়ালি থানার ওসি এমদাদুল হক শেখ জানান, প্রেমঘটিত কারণে বন্ধুদের ছুরির আঘাতে শরিফের মৃত্যু হয়েছে। তিনি আরো জানান, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে নাজমুল নামে একজনকে আটক করা হয়েছে। বাকিদের দোষ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততা খুঁজে না পেয়ে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে।


এবার আসুন দেখি মাহতাব কোন খবর পড়ছে-

বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্রেমিকের হাতে প্রেমিকা খুন

রাজধানীর শাহআলী থানাধীন মিরপুর-২ এলাকায় অবস্থিত বোটানিক্যাল গার্ডেনে ডেটিং করতে গিয়ে প্রেমিকাকে উড়না দিয়ে পেঁচিয়ে হত্যা করেছে প্রেমিক। অজ্ঞাত তরুণীর বয়স আনুমানিক ২৫ বছর বলে জানিয়েছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টার দিকে গার্ডেনের দর্শনার্থী ও নিরাপত্তারক্ষীদের দেয়া খবরের ভিত্তিতে ফুলবাগান থেকে শাহআলী থানা পুলিশ অজ্ঞাত ওই প্রেমিকার লাশ উদ্ধার করে। সুরতহাল রিপোর্ট শেষে ময়নাতদন্তের জন্য লাশটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছে।
শাহআলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সেলিমুজ্জামান নিউজ বিডি ডটনেটকে বলেন, বোটানিক্যাল গার্ডেনের ফলবাগানে পড়ে থাকাবস্থায় আমরা ওই তরুণীর মৃতদেহ উদ্ধার করি। নিহতের গলায় কালো দাগ এবং নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হওয়া অবস্থায় ছিল। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ওড়না দিয়ে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।
গার্ডেনের নিরাপত্তারক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে সন্দেহভাজন যুবককে শনাক্ত করে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানান ওসি। জানা গেছে, দুপুরের দিকে বোরকা পরিহিত এক তরুণী ও এক যুবক গার্ডেনে প্রবেশ করে। তাদের চালচলন ছিল প্রেমিক-প্রেমিকার মতো। ডেটিং করার জন্যই তারা ফুলবাগান এলাকায় অবস্থান করছিল। বিকালের দিকে তরুণীর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশ এসে উদ্ধার করে।


যার যার হাতের খবরটি পড়ে দুজনেই কিছু সময়ের জন্য চুপ করে থাকল। নীরবতা ভাঙল স্পীকারে ভেসে আসা মৃত্যুদূতের কণ্ঠস্বর। “এবার নিশ্চয়ই বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না সেই বিশেষ অপরাধটি কি!”
কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর একসময় আরিফ অস্ফুট কণ্ঠে বলল, “মিথ্যে কথা! এই কাজ আমি করিনি। শরিফকে আমি খুন করিনি”।
মৃত্যুদূতের অট্টহাসি শোনা গেল স্পীকারে। হাসতে হাসতেই বলল, “এই কথা আপনি পুলিশকে বলেছেন আরিফ। আমাদের কাছে মিথ্যা বলে কি লাভ? কোন কিছুই আমাদের অজানা নয়”।
“বিশ্বাস করুন শরিফকে আমি খুন করতে চাইনি। ব্যাপারটা ছিল এক্সিডেন্ট! সে জানত আমি লামিয়াকে ভালবাসি, তারপরও সে...” আর কিছু বলতে পারল না আরিফ। গলা ধরে এলো তার।
“আপনিও কি কিছু বলতে চান মাহতাব?”
“মেয়েটি আমার সাথে চিটিং করেছিল”। মাহতাবের কণ্ঠ থেকে ঘৃণা ঝরে পড়ল যেন! “আমার আগেও অনেক ছেলের সাথে সে প্রতারণা করেছে!”
“কোন কারণই তকে খুন করার পক্ষে যথেষ্ট নয় মাহতাব! একজন মানুষের জীবন মৃত্যু নিয়ে আপনি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, যতক্ষণ না সে অন্য কাউকে হত্যা করার মত জঘন্য অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে”।

আরও কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। দেয়াল ঘড়িটা নষ্ট না হলে এখন তার সেকেন্ডের কাটা ঘোরার সময় টিক টিক শব্দ স্পষ্ট শোনা যেত!

মৃত্যুদূত ইচ্ছাকৃত কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিল। “তাহলে শুরু করা যাক আমাদের মৃত্যুপথ খেলার প্রথম রাউন্ড! টেবিলের ওপর একটা পিস্তল রাখা আছে, সম্পূর্ণ ম্যাগাজিন গুলি ভরা। সেফটি ক্যাচ অফ করা আছে। কোন ঝামেলা নেই। আপনাদের দুজনের মধ্যে যে আগে পিস্তলটি তুলে নিয়ে অপরজনকে লক্ষ করে গুলি করতে পারবে সে দ্বিতীয় রাউন্ডে উত্তীর্ণ হবে। আপনাদের উভয়ের ডান পায়ে একটা করে অ্যাঙ্কলেট লাগানো আছে। এটা একই সাথে একটা মুভমেন্ট ট্রাকার, লিসেনিং ডিভাইস, মাইক্রো ক্যামেরা এবং একটা সেলফ ডিজপসেবল বোমা। আপনার প্রত্যেকটি মুভমেন্ট পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে সেট করা টাইম অনুযায়ী এখন থেকে ঠিক ত্রিশ মিনিটের মধ্যে বোমাটি বিস্ফোরিত হবে। তাই যা করার ত্রিশ মিনিটের আগেই করতে হবে। আপনাদের সময় শুরু হচ্ছে এখন...

“রাউন্ড ওয়ান”

সামনে বসে থাকা ছেলেটির দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে মাহতাব। ইতিমধ্যে সে একটু ধাতস্থ হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ছেলেটিকে দেখে মনে হচ্ছে সে এখনও ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পুরো ব্যাপারটি যে স্বপ্ন নয়, মানুষের মরণশীলতার নগ্ন বাস্তব সেটা এখনও তার মস্তিষ্ক গ্রহণ করতে পারেনি। এক দৃষ্টিতে টেবিলে পড়ে থাকা পিস্তলটার দিকে তাকিয়ে আছে...

“আপনাদের জন্য বরাদ্দ সময়ের পাঁচ মিনিট ইতিমধ্যে পেড়িয়ে গেছে”। স্পীকারে ভেসে এলো মৃত্যুদূতের কণ্ঠস্বর।

মাহতাব যুক্তি দিয়ে পরিস্থিতি বিচার করার চেষ্টা করছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে কোন উদ্ভট পাগলের খপ্পরে পড়েছে। কিন্তু বোটানিক্যাল গার্ডেনে সেদিন যা ঘটেছিল তা কাকপক্ষীও টের পাওয়ার কথা নয়! একজন উন্মাদ তা জানবে কি করে? তারমানে এই আয়োজনের পিছনে কেবল একজন মানুষ নয়! তারা আটঘাট বেধেই নেমেছে। ওদের কথামত কাজ না করলে অদৃষ্টের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই...

“পনের মিনিট শেষ! বরাদ্দকৃত সময়ের মাঝ পথে আছি আমরা। আর একবার আপনাদের মনে করিয়ে দেই। কোন অবস্থাতেই অতিরিক্ত সময় দেয়া হবেনা। শুধুমাত্র একজন অপরজনকে খুন করলেই আমরা অ্যাঙ্কলেটের ভেতরকার বিস্ফোরকটির টাইম রিসেট করে দেব। তাই বলছি- ভাবনা চিন্তা সংক্ষিপ্ত করুন। শেষে কিন্তু দুজনেই বোমা ফেটে মারা পড়বেন। আমরা চাইনা আমাদের মৃত্যুপথ খেলার একটি সিজন গোড়াতেই পন্ড হয়ে যাক। আমরা জমজমাট উত্তেজনায় ভরপুর পাঁচটি রাউন্ডের অপেক্ষায় আছি”।

এক হাত বাড়িয়ে পিস্তলটা তুলে নিলেই হল। ট্রিগার টিপতে আর কতক্ষণ লাগবে? মাত্র দু সেকেন্ডের ব্যাপার! ব্যাস, খেল খতম! খুন আগেও করেছে মাহতাব। কিন্তু সে খুনের পিছনে একটা বিশ্বাস কাজ করেছিল। সমস্ত অস্তিত্ব-জুড়ে একটা প্রতিশোধ স্পৃহা স্পষ্টরুপ ধারণ করেছিল। কিন্তু এখন কোন বিশ্বাস নিয়ে খুন করবে সে? সামনে বসে থাকা ইনোসেন্ট চেহারার ছেলেটাকে খুন করার চাইতে তাই বাঁচার অন্য উপায় খুঁজে বের করা অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে...

“পঁচিশ মিনিট সম্পূর্ণ হয়েছে। আর মাত্র পাঁচ মিনিট সময় আছে হাতে। এর মধ্যে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব সম্পাদন করতে ব্যর্থ হলে উভয়েই মারা পড়বেন। নিজেকে বাঁচাতে হলে অপরের নিয়তিতে মৃত্যু লিখে দেওয়া ছাড়া আপনাদের সামনে পথ খোলা নেই”।

হঠাৎ আরিফ ঝট করে হাত বাড়িয়ে পিস্তল তুলে নিল। প্রমাদ গুনল মাহতাব। ভেবেছিল শেষ মুহূর্ত অপেক্ষা করে দেখবে অন্য কোন উপায় খুঁজে পাওয়া যায় কিনা! কিন্তু আরিফ ততক্ষণ অপেক্ষা করে থাকতে রাজি নয়। সে মাহতাবের বুক বরাবর পিস্তলের নিশানা করল। মাহতাব লক্ষ করল আরিফের চোখে মুখে দ্বিধা। কয়েক মুহূর্ত নীরবে কাটল। কিন্তু বিবেকের সাথে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত আর পারল না আরিফ। পিস্তল নামিয়ে রেখে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। মেনে নিয়েছে ভাগ্যকে। এই ভাবে যদি তার মৃত্যু লেখা থাকে, তবে তাই হোক....

“আর মাত্র দুই মিনিট বাকি। সময় ফুরোবার পথে। আমরা এখনও আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয়ীকে খুঁজে পাইনি। এটা খুবই দুঃখজনক যে চমৎকার একটি খেলা খেলোয়াড়দের ভুলে শুরুতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে!”

মাহতাব হাত বাড়াল। অন্য একটা উপায় খুঁজে পেয়েছে। পিস্তলটা নিজের মাথায় ঠেকাল সে, ট্রিগারে আঙ্গুল রাখল। বিনা কারণে একজন মানুষকে খুন করা সম্ভব নয় তার পক্ষে। আবার বোমায় উড়ে গিয়ে জঘন্য ধরনের মৃত্যুও সহ্য হবেনা। তারচেয়ে বরং এটাই ভাল! ট্রিগার টেনে দিলে দু সেকেন্ডের জন্য জীব জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যথা অনুভূত হবে। তারপর সব শেষ! শুরু হবে অনুভূতিহীন এক বিশাল শুন্যতার জগত...

আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড। কয়েকবার ট্রিগার টিপতে গিয়েও থেমে গেছে মাহতাব। তার ধারনা ভুল ছিল! কাউকে খুন করার চাইতে আত্মহত্যা করা অধিক কঠিন। আর হয়ত পাঁচ সেকেন্ড আছে! ঝট করে এলো সিদ্ধান্তের পরিবর্তন। পিস্তল নিশানা করে ট্রিগার টেনে দিল মাহতাব। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বিকারহীন ভঙ্গিতে পড়ে ছিল আরিফ। সে হয়ত জানত না ক্লোজ রেঞ্জে একটা পয়েন্ট থ্রি টু ক্যালিবারের বুলেট শটগানের বুলেটের তুলনায় কোন অংশে কম নয়! মাথার খুলির একপাশ প্রায় উড়ে গেল তার। ছিটকে বেরিয়ে এলো মগজ! যেন বলতে চাইছে- জঘন্য এক কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত নিশ্চিত হল।

“রাউন্ড টু”

ঝিনাইদহ সদর থেকে কুমারখালি উপজেলা পর্যন্ত যাত্রাপথে অন্তত দুই বার ট্রাক থামাতে বাধ্য হয় হোসেন মিয়া। সাধারণত খুব সকালে দুইটা গরম ভাজা পরোটা আর এক কাঁপ চা খেয়েই রওনা দেয় সে। মাথার ওপর সূর্য যখন দ্বিপ্রহরের ঘোষণা দেয়, তখন সস্তাদরের একটা হোটেল দেখে ট্রাক থামিয়ে নেমে পড়ে। ভর্তা-ভাজি-মাছ দিয়ে দু প্লেট ভাত পেটে চালান করেই আমার রওনা। তবে বিকেলের নরম রোদের ছোঁয়া লাগার শরীরে লাগার সময়টাতে আরও একবার থামার প্রয়োজন হয় তার। এইবার থামার জন্য নির্দিষ্ট কোন যায়গা বাছতে হয়না। প্রকৃতির ডাক তো আর বলে কয়ে আসেনা! বড় কোন রেস্টুরেন্ট, ক্লিনিক কিংবা মসজিদে চোখে পড়তেই ট্রাক থামিয়ে নেমে পড়ে হোসেন মিয়া। কাজ সেরে এসে আবার শুরু হয় যাত্রা।

দীর্ঘ দশ বছর যাবত এই রুটিন মেনে দক্ষিণে ঝিনাইদহ থেকে উত্তরে কুমারখালি পর্যন্ত মালামাল আনা নেওয়ার কাজে অভ্যস্ত হোসেন মিয়া। আগে মহাজনের ট্রাক চালাত, পয়সা জমিয়ে এখন নিজেই ট্রাক কিনেছে। তবে আজই প্রথম তার রুটিনে একটু পরিবর্তন লক্ষণীয়। আজ যে সাহেবের মালামাল নিয়ে যাচ্ছে লোকটা সম্ভবত পয়সাওয়ালা পাবলিক। আজ দুপুরে বড় রেস্টুরেন্টে নানা পদের চেনা অচেনা মুখ-রোচক খাবার পেট ভরে খাওয়ার সুযোগ মিলেছে। শাহী খানা শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে আয়েশি ভঙ্গিতে রওনা দিয়েছে আবার। তবে সাহেব লোকটা শুধু টাকার দিক দিয়ে বড়লোক তাই নয়, মনের দিক থেকেও লোকটা বড়। সারা পথ ট্রাকে তার পাশে বসে অনর্গল বক বক করছে। এমন ভাল মানুষের দেখা কালে ভদ্রে মিলে, সচরাচর তো কখনই নয়। ট্রাক জুড়ে কয়েক বস্তা ভর্তি সাদা কাগজ, এত কাগজ নিয়ে করবে কি লোকটা? সম্ভবত প্রিন্টিং এর ব্যবসা আছে।

“হোসেন মিয়া ট্রাকটা একটু সাইড করেন দেখি”!
হোসেন মিয়া তাকিয়ে দেখল আশে পাশে দোকান পাট, বাড়ি ঘর কিছুই নেই। উঁচু রাস্তার এক ধারে বড় বড় গাছ পালা, অন্যপাশে ফসলের ক্ষেত। সে জিজ্ঞেস করল, “এই খানে নামবেন ক্যান স্যার? বিরান অঞ্চল! আশে পাশে তো কিছু নাই”।
সেই জন্যই তো এখানে নামছি হোসেন মিয়া! লোকটা দাঁত বের করে হাসল। ডানহাতের কড়ে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, “ছোট কাজ ডেকেছে”!
হোসেন আলী হি হি শব্দে চাঁপা হাসি হেসে বলল, “ঠিক আছে স্যার, নামেন! কোন সমস্যা নাই”!
ঘন ঝোপের পাশ ঘেঁষে ট্রাক থামাল হোসেন মিয়া। লোকটা দরজা খুলে নেমে গেল।
“আপনিও নেমে পড়ুন হোসেন মিয়া। দেখেন কি চমৎকার বাতাস লাগছে!”
সাহেব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুকুর স্টাইলে ছোট কাজ সাড়ছে। হোসেন মিয়া প্রশ্ন করল, “স্যার আপনের নামটা তো এখনও জানা হইল না!”
“আমার নাম মাহতাব চৌধুরী”।
“বাহ! ভাল মানুষের ভাল নাম”!
ছোটকাজ শেষে প্যান্টের জিপার আটকাচ্ছে মাহতাব। হোসেন মিয়া দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে উঠতে উদ্যত হল। মাহতাব বলল, “এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন হোসেন মিয়া? বউ তাড়াতাড়ি ফিরতে বলে দিয়েছে নাকি?”
হোসেন আলী দাঁত বের করে বলল, “না, স্যার! বেলা থাকতে থাকতে পৌঁছাইতে চাইতেছি। রাইত হলে মেলা সমস্যা, যায়গা বেশি সুবিধার না”।
“তা তো বুঝলাম। কিন্তু তাড়াহুড়োর ফল কখনও ভাল হয়না সেটা জানেন তো?”
“জী স্যার, জানি!”
মাহতাব পকেট থেকে একটা পেপারের ছেঁড়া অংশ বের করল। “হোসেন মিয়া বাংলা পড়তে পারেন তো?”
“জী স্যার। ক্লাস ফাইভ পাস দিছিলাম”।
“দেখেন তো কি লেখা আছে এখানে”। পেপার কাটিংটা হোসেন মিয়ার হাতে ধরিয়ে দিল মাহতাব।

হোসেন মিয়া কাগজটা হাতে নিয়া দু লাইনের বেশি পড়তে পারল না। তার সমস্ত মুখ ফ্যাকাসে রূপ ধারণ করেছে। হোসেন মিয়া পড়েনি বলে কিন্তু আমরা তো দর্শকদের বঞ্চিত করতে পারিনা! চলুন হোসেন মিয়ার হাতে ধরা পেপার কাটিং এর উপর একটু নজর বুলিয়ে নেই....

“শৈলকুপায় ট্রাক চাপায় ছাত্র নিহত”

ঝিনাইদহের শৈলকুপায় ট্রাক চাপায় ইমন হোসেন (১৩) নামের এক মাদ্রাসা ছাত্র নিহত হয়েছে। রবিবার সকাল ৮টায় কুষ্টিয়া সড়কের সতেরো মাইল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত ইমন শৈলকুপা উপজেলার সাধুখালি গ্রামের মসিউর রহমান বাবুর ছেলে। সে বড়দাহ দাখিল মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র।
শৈলকুপা থানার ওসি আনোয়ার জানান, ঝিনাইদহ থেকে আলুবোঝাই একটি ট্রাক বিপরীত দিক থেকে আসা মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই ইমন নিহত ও তার বাবা গুরুতর আহত হয়। উল্লেখ্য যে প্রত্যক্ষদর্শী না থাকায় ঘটনায় দায়ী ট্রাক ও ড্রাইভারকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।


“কি ব্যাপার হোসেন মিয়া? পড়ে দেখুন কি লেখা আছে!”
“কে আপনে?” হোসেন মিয়ার কণ্ঠস্বর কেঁপে গেল।
মাহতাব ঠোঁটের কোনে হাসি দেখা গেল। “আমি মৃত্যু পথের যাত্রী হোসেন মিয়া, ঠিক আপনার মত”।
হোসেন মিয়া দ্রুত চিন্তা করার চেষ্টা করছে, কিন্তু চিন্তাগুলো সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই সে খেয়াল করল যায়গাটা শৈলকূপা, কাছেই সাধুখালি গ্রাম। এখানেই কোথাও বছর তিনেক আগে সেই ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটেছিল।
“কি চিন্তা করছেন হোসেন মিয়া”?
অবশেষে হোসেন মিয়া ঠিকঠাক চিন্তা করতে সমর্থ হল। দ্রুত ট্রাকে উঠে পালাতে হবে!
“ভুলেও পালানোর কথা ভাববেন না! অনেক পালিয়েছেন, আর কত? নিয়তির কাছে এবার নতি স্বীকার করুন”!
মাহতাবের হাতে বেরিয়ে এসেছে চকচকে সাইলেন্সার লাগানো ওয়ালথার পিপিকে, মৃত্যু বর্ষণের জন্য প্রস্তুত! পিস্তলটা দেখে আতংকেড় ঢেউ নামল হোসেন মিয়ার শিরদাঁড়া বেয়ে। একটা ঢোক গিলে ফেলল অজান্তেই। “বিশ্বাস করেন স্যার! আমার কোন দোষ ছিলনা। ঐদিন ট্রাকের ব্রেকটা একটু ঝামেলা করতাছিল”!
“হাসালেন হোসেন মিয়া! হাসালেন”। বিদ্রুপের সুরে বলল মাহতাব। “হাসিখুশি বাপ ছেলে মোটর সাইকেলে চেপে আসছিল! আপনি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সোজা চাকা উঠিয়ে দিলেন তাদের উপর! আপনি জানেন যে আঘাতের পরও ছেলেটা বেঁচে ছিল! সময়মত হাসপাতালে নিলে বাঁচানো যেত। কাপুরুষের মত পালিয়ে না গিয়ে বাপ ছেলেকে ট্রাকে তুলে একটা হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে সরে আসতেন! কেউ ঘুনাক্ষরেও জানত না কাজটা কে করেছে”!
“আমার মাথা কাজ করে নাই স্যার! আমারে মাফ কইরা দেন”।
“মাফ করে দিতে গেলে যে নিজেকে হার মানতে হয়! অদৃষ্ট আমাদের নিয়ে খেলছে হোসেন মিয়া। এই খেলায় আমি পরাজিত হতে চাইনা”! হোসেন মিয়ার বুক বরাবর নিশানা করল মাহতাব। গুলি করার অভিজ্ঞতা তার নেই, স্বভাবতই হাতের টিপ ভালনা। কিন্তু এত কাছ থেকে টার্গেটে গুলি লাগাতে হাতের টিপ ভাল হওয়ার কোন প্রয়োজনীয়তা সে দেখছে না। খেলাটা সে উপভোগ করছে এখন!

সেই রাতে হোসেন মিয়ার মৃতদেহ আবিষ্কার করল গ্রামের মানুষজন। বুকের বা পাশটাতে একটা গুলির চিহ্ন! এক ট্রাক ভর্তি কাগজ নিয়ে জনবসতি থেকে দূরে একজন ট্রাক ড্রাইভার গুলি খেয়ে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকার পেছনে বিরাট কোন রহস্য থাকার সম্ভাবনা কারো মাথায় খেলল না। পুলিশ একটা দায়সারা টাইপের তদন্ত শেষে ডাকাতের হাতে খুন বলে রিপোর্ট করে দিল। দৈনিক পত্রিকার পাতায়ও ছোট্ট করে একটা নিউজ দেখা গেল। নিউজের হেডলাইন- “শৈলকূপায় দুর্বৃত্তদের হাতে ট্রাক ড্রাইভার খুন”।

“রাউন্ড থ্রি”

ছোট ছোট পদক্ষেপে নতুন ভাড়াটিয়ার রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল পারভীন। আশে পাশে নজর বুলিয়ে দেখে নিল কেউ লক্ষ করছে কিনা। তারপর দরজায় নক করল। ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, “কে?”
“মাহতাব ভাই, আমি পারভীন। ভীতরে আসতে পারি?”
“তোমার বাড়ি তোমার ঘর না আসতে পারার তো কোন কারণ দেখিনা!”

দরজা একটু ফাক করে ভেতরে ঢুকে পড়ল পারভীন। মাহতাব চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছিল। তার দিকে তাকিয়ে চমৎকার একটা হাসি দিল। সেই হাসিতে পারভীনের ভেতরকার পৃথিবীতে একটা ছোট খাট ঝড় বয়ে গেল। চোখ নামিয়ে নিল সে, ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠল অভিসারে বের হওয়া তরুণীর লাজুক হাসি। খাটের কিনারায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল, “কি করেন মাহতাব ভাই?”
“পুরনো পত্রিকা পড়ি”।
“পুরান পত্রিকা পইড়া কি লাভ? সব খবর তো পুরান হয়ে গেছে”!
“কিছু খবর কখনও পুরনো হয়না পারভীন। অদৃষ্টের নিয়ম তাকে পুরনো হতে দেয়না”।
“আপনার কথা বেশির ভাগই বুঝিনা আমি কিন্তু শুনতে ভাল লাগে”।
মাহতাব নীরবে আবার সেই হাসি উপহার দিল তাকে।
পারভীন নিজের গলায় দামী নেকলেসটাতে হাত বুলচ্ছে। গতকাল এটা মাহতাব তাকে গিফট করেছে। বলল, “কেমন লাগতেছে আমারে?”
“চমৎকার! অপ্সরীর মত লাগছে তোমাকে!” বলে পত্রিকা চেয়ারে রেখে উঠল মাহতাব। পারভীনের কাছে এসে বসল। “কিন্তু পারফেক্ট মনে হচ্ছেনা। শাড়ির কালারটা আরও একটু ডিপ হলে মনে হয় বেশি ভাল লাগত”।
“হ, আমারও মনে হইতাছিল আর একটু ডিপ কালারের শাড়ি হইলে ভাল হইত”। কথাটা মিথ্যা বলেছে পারভীন। তার মনে হয়েছিল হয়ত মাহতাবের চোখে হালকা রঙের শাড়ি ভাল লাগবে। “কিন্তু কি করমু? ডিপ কালারের শাড়ি নাই তো!”
“এই কথা আমাকে আগে বলবে না? আহা! এমন সুন্দর একটা অবয়ব সামান্য ডিপ কালারের শাড়ির অভাবে প্রস্ফুটিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেনা! তাই কি হয়? আমি কালই ব্যবস্থা নিচ্ছি”।
“মাহতাব ভাই আপনি এইগুলা কেন করেন আমার জন্য?”
“তোমাকে ভাল লাগে তাই”। দ্বিধাহীন উত্তর মাহতাবের।
“সত্যি বলতেছেন?”
“অমন সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে কেউ কি মিথ্যা বলতে পারে?” পারভীনের মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহতাব।
“আপনার মুখে কিচ্ছু আটকায় না!”

তারপর কিছুক্ষণ মধুর নিরবতা। ঘরের ভেতর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকা দুজন নর নারীর নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ ব্যতীত অন্য কোন শব্দ নেই।
পারভীন নিরবতা ভাঙল, “আচ্ছা মাহতাব ভাই, একটা প্রশ্ন করি?”
“যা খুশি প্রশ্ন কর, অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন নেই। তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে যদি সমস্ত জীবন নিঃশেষ হয়ে যায়, আমি তাতেও দ্বিধান্বিত হবোনা”।
“আপনার তো অনেক টাকা পয়সা আছে। ভাল চাকরী করেন। ভাল যায়গায় গিয়া থাকার ক্ষমতা আছে। তাইলে আপনি ক্যান এই খানে আইসা বাসা ভাড়া নিলেন?”
“তোমার জন্য”।
“ধুর আপনে মিথ্যা বলতাছেন। আমারে পটানোর জন্য অনেক মিথ্যা বলছেন। আমার সাথে তো আপনার এইখানে আইসা পরিচয়”।
“মিথ্যা না! আমার এখানে আসার কারণ তুমিই। তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম একটা মার্কেটে কেনা কাটা করার সময়। তারপর থেকে আমার রাতের ঘুম হারাম! মাথায় শুধু একটাই চিন্তা কাজ করত- যেমন করেই হোক তোমার সান্নিধ্যে আসতে হবে। তারপর জানলাম তুমি এই বাড়ির মালিক। এখানে একটা রুম খালি আছে শুনে তাই আর দেরি করিনি”।
“কিন্তু আমি তো বিবাহিত...”
“বিবাহিত এবং অসুখী”। কথাটা সম্পূর্ণ করে দিল মাহতাব। “আমি জানি স্বামীর সাথে তোমার বনিবনা হচ্ছেনা। তোমার টাকায় খেয়ে পড়ে বজ্জাত লোকটা তোমার উপরে মাতব্বরি করে। তোমার মত সুন্দরী স্ত্রীকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়ার যোগ্যতা তার নেই”।
“ঠিক বলছেন। আসলামরে বিয়ের আগে যেমন মনে করছিলাম সে তেমন না”। মনের আক্ষেপ কণ্ঠে ফুটে উঠল পারভীনের। “আমার পয়সা উড়াইয়া সে মদ গাঞ্জা খাইয়া আসে। আমি কিছু বলতে গেলেই যা তা ব্যাবহার করে”।
“থাক। কষ্ট পেওনা। আমি চলে এসেছি। কারো রাগ, ঘৃণা কিংবা হিংসা আর তোমায় স্পর্শ করতে পারবে না”। এক হাত বাড়িয়ে পারভীনের গাল স্পর্শ করল মাহতাব। একদম কাছে চলে এসেছে। তরল কণ্ঠে বলল, “তোমার উপরে সমস্ত অধিকার এখন থেকে একমাত্র আমার”।

মাহতাবের হাতের ছোঁয়ায় পারভীনের সমস্ত শরীরে শিহরন জাগাল। সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, “কিন্তু আমি তো অশিক্ষিত মেয়েমানুষ, আপনি জ্ঞানী গুনি মানুষ। আপনার সাথে আমার মেলেনা”।
“কে বলেছে মিলেনা? তোমার আর আমার পথ একই। নিয়তি আমাদের এক সূত্রে গেঁথে দিয়েছে পারভীন”।

মাহতাব আরও কাছে চলে এসেছে। পারভীনের গলার কাছটায় তার গরম নিঃশ্বাসের ছোঁয়া লাগছে। একবার মাহতাবের দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল সে। পুরুষ মানুষের ঐ দৃষ্টির কি অর্থ তা পারভীনের অজানা নয়। মাহতাবের ছোঁয়ায় কাছে পাওয়ার আহবান। তার নারী সত্তাও জেগে উঠছে, সাড়া দিচ্ছে সেই ডাকে। সমস্ত শরীরে গ্রহণ করতে চাইছে পুরুষের আস্বাদ। দুজন পরস্পরের একদম কাছে চলে এসেছে। দুজোড়া ঠোঁটের মাঝে কেবল একচুল দূরত্ব।

আচমকা পিছিয়ে গেল মাহতাব। পারভীনের নাক মুখ লক্ষ করে ডানহাতে প্রচণ্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হওয়ার সুযোগ পেলনা পারভীন। ছিটকে গিয়ে দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়েই মাথা ঘুরে উঠল। হাঁটুর নিচে বল পাচ্ছে না সে, পরে যাচ্ছে, প্রানপনে কিছু একটা ধরে তাল সামলানোর চেষ্টা করল। মাহতাব দ্রুত এগিয়ে এসে ধরে ফেলল তাকে। মুখের ওপর শক্ত টেপ লাগিয়ে দিল যেন চিৎকার করতে না পারে। তারপর তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসিয়ে
 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on February 15, 2014 19:28
No comments have been added yet.


গুডরিডস ব্লগ

Nazim Ud Daula
এই ব্লগে নাজিম উদ দৌলার লেখা ছোট গল্পগুলো পড়তে পাওয়া যাবে।
Follow Nazim Ud Daula's blog with rss.