Nazim Ud Daula's Blog: গুডরিডস ব্লগ

April 30, 2015

অপছায়া

রাত ১১টায় কলিং বেল বাজার আওয়াজ শুনে আমার ভ্রু খানিকটা কুঁচকে গেল। এত রাতে সাধারণত আমার কাছে কেউ আসেনা! আমি খাবার টেবিলে সব কিছু সাজিয়ে নিয়ে খেতে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

এই ফ্ল্যাটটা আমার দাদার কেনা। বাবা ছিলেন দাদার এক মাত্র সন্তান। দাদা মারা গেলেন, দাদি গেলেন, বাবা মাও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন- সবাই মরেছেন এই ফ্ল্যাটেই। এখন আছি আমি একা! অবশ্য সম্পূর্ণ একা কি বলা যায়?

আবার কলিং বেল বাজতেই ভাবনায় ছেঁদ পড়ল আমার। উঠে গেলাম কে এসেছে দেখতে। লুকিং গ্লাসের বাইরে দাঁড়ানো লোকটাকে তেমন চেনা যাচ্ছেনা।আমি হেঁড়ে গলায় জিজ্ঞেস করলাম, "কে? কে ওখানে?"

"আমি, নাজিম ভাই"! লোকটা উত্তর দিল।"আমি জামিল"

জামিল হায়দার! আমার অফিসের কলিগ! হুজুগে টাইপের স্বভাব, অতিরিক্ত কথা বলে! লোকটা এত রাতে আমার বাড়িতে কি মনে করে এসেছে? আমি দরজা খুলে দিলাম। মুখে সামাজিকতার হাসি ধরে রেখে বললাম, "আসুন জামিল ভাই, হঠাৎ কি মনে করে?"

জামিল হায়দার ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে উত্তর দিল, "আমার এক আত্মীয়র বাড়ি আপনাদের গলির মুখেই। ওনার কাছে একটা দরকারে এসেছি, রাতে ওখানেই থাকব। তাই ভাবলাম এক ফাকে আপনার কাছ থেকেও ঘুরে যাই"।

"ভাল করেছেন। আমি খেতে বসছিলাম, আপনিও আসুন"।

"আরে না না"। জামিল হায়দার বেকুবের মত হাসল। "আমি পরে খাব ভাই, আপনি খেয়ে আসুন।"

"খামাখা কেন মিথ্যা বলছেন জামিল ভাই?" আমি মুখে অমায়িক হাসি ধরে রেখেছি। "আপনার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে আপনার দারুণ খিদে পেয়েছে!"

এয়ার জামিল হায়দার লজ্জা ভেঙে এসে আমার সাথে খেতে বসল।

খানিকক্ষণ নিরবে কাটল। জামিল হায়দারই প্রথমে নিরবতা ভাঙল। "একটা প্রশ্ন করি নাজিম ভাই?"

"জি করেন"।

"আপনি এত ভাল একজন মানুষ! ভাবী কীভাবে পারল আপনাকে ছেড়ে যেতে?"

প্রশ্নটা শুনে আমার মুখের ভেতর টেস্টিং লস্ট দিয়ে রান্না করা খাবার হঠাৎ তেঁতো লাগল। আমি উত্তর দিলাম না, একটু হেসে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।

জামিল হায়দার তবুও নাছোড়বান্দা। বলে যাচ্ছে- "এই যে আপনি এখন উত্তরটা এড়িয়ে যেতে চাইছেন! পিওর ভদ্রলোক যাকে বলে! অন্য কেউ হলে বউয়ের নামে এক গাঁদা অভিযোগ ছুড়ে দিত! কিন্তু আপনি তো ভাল মানুষ। আপনি তো কিছুই বলবেন না! বলুন না ভাই? জানতে খুব ইচ্ছে করে! কোন কথা নেই, বার্তা নেই, হঠাৎ আপনার স্ত্রী আপনাকে ফেলে পালিয়ে গেল? কিন্তু কেন?"

আমি প্রমাদ গুনলাম! এর হাত থেকে কতক্ষনে পরিত্রাণ পাব কে জানে? কথাটা এড়াতে বললাম, "এই যে মগজ ভুনাটা নিন জামিল সাহেব! আমার নিজ হাতে রান্না করা। ভাল মজা পাবেন। আর ডালটাও একটু চেখে দেখবেন, জলপাই দেওয়া ডাল, টক টক লাগে, অপূর্ব স্বাদ হয়েছে!"

এর পর আমি নানা প্রসঙ্গে কথা বলে প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু জামিল হায়দার তো তা বুঝতে চাচ্ছে না! সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে! এই লোকটা আমার হাড় জ্বালিয়ে খাচ্ছে! অফিসে সারাদিন কানের কাছে এসে ঘ্যান ঘ্যান প্যান করে! মাঝে মধ্যে আমার মনে হয় তার বুঝি কাজই হচ্ছে মানুষের কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করা! এই জন্যই মাস শেষে অফিস থেকে বেতন পায়। কথা না বলে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে- তাকে এমন অবস্থায় মনে হয়না কেউ কখনও দেখেছে!

অবশেষে বিরক্তির শেষ সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর বললাম- "আপনি শুনতে চান কেন আমার বউ আমাকে ছেড়ে পালিয়েছে?"

জামিল হায়দার জিভে কামড় দিয়ে বলল, "ওমা! ছিঃ ছিঃ পালানোর কথা আসল কোথথেকে? আমি এমনিতেই জিগেস করলাম উনি কই আছে? কবে ফিরবে ইত্যাদি!"

আমি খুব শান্ত মেজাজে বললাম, "পুরোটা শুনবেন নাকি শেষ টুকু?"

"পুরোটাই শুনতে চাই"। আনন্দে জামিল হায়দারের চোখ দুটো চক চক করছে! না জানি কতদিন অপেক্ষা করে আছে সে এই ঘটনা শুনার জন্য! আমাকে উৎসাহ দেয়ার জন্য বলল, “বাই দা ওয়ে! গরুর মগজ ভুনাটা কিন্তু দারুণ হয়েছে খেতে! আর সেই সাথে ডাল! আহ কি অপূর্ব স্বাদ!”

আমি বলতে শুরু করলাম-

এই ফ্ল্যাটটা আমার দাদা কিনেছিলেন। কেনার কিছুদিন পরই দাদা মারা যান। বাবা ছিল তার একমাত্র সন্তান। এর পর এই ফ্ল্যাটে দাদি আর বাবাই শুধু বসবাস করতেন। কিন্তু দাদা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর থেকেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটতে থাকল। ঠিক রাত ১২টা বাজতেই ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে কেমন যেন খস খস আওয়াজ শুনা যায়। মনে হয় কেউ একজন পা টেনে টেনে হেঁটে যাচ্ছে!

“তাই নাকি? এতো সাংঘাতিক ব্যাপার!” জামিল হায়দারের গলায় টিটকারির সুর চিনতে আমার ভুল হলনা। বুঝলাম ভদ্রলোক আমার কথা কিছুই বিশ্বাস করছেন না! তবুও আমি না থেমে বলে যাচ্ছি-

শব্দটা কেমন যেন অদ্ভুত ধরণের! এমনিতে আমরা যখন ভেতরের রুমে থাকি তখন শোনা যায় কিন্তু কেউ একজন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে শব্দটা আর শোনা যায় না! অনেক কিছু করেছেন দাদি, কিন্তু কিছুতেই এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পান নি। কেউ ই যখন এই ব্যাপারে কিছুই করতে পারল না, তখন আমার দাদি একজন জ্যোতিষীর শরণাপন্ন হলেন।

জ্যোতিষী বললেন, “এটা কোন একটা অভিশাপের ফল! তোর পরিবারের ওপর বড় ধরণের কোন অভিশাপ আছে। তোর স্বামীর পরিবারের কেউ একজন সম্ভবত বিরাট বড় কোন অপরাধ করে বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু যার সাথে ঐ অপরাধ করেছিল সে তো মাফ করেনি! তাই তোদের পিছু নিয়েছে এক অশরীরী ছায়া! এই বাসা পাল্টেও কোন লাভ নেই! যেখানেই যাস, এই ছায়া তোদের পিছু নেবে!”

দাদি জিজ্ঞাসা করলেন, “কিন্তু এই অভিশাপ থেকে মুক্তির কি কোন উপায় নেই?”

জ্যোতিষী উপায় বাতলে দিলেন, “তোর ছেলের বিয়ে দিয়ে যখন বাড়িতে বউ আনতে পারবি, তখন এই সমস্যা দূর হবে”।

দাদি এই কথা বিশ্বাস করেছিলেন কি না জানিনা, কিন্তু জ্যোতিষীর কথা মত কাজ হল। আমার মা যে রাতে এই ফ্ল্যাটে পা রাখলেন, সেদিন থেকে বাড়ির বারান্দায় আর ঐ খস খস শব্দ শোনা গেলনা। দাদি হাফ ছেড়ে বাঁচলেন! অবশেষে বারান্দায় অশরীরী আত্মার হাঁটাহাঁটি বন্ধ করা গেছে। সেই স্বস্তি নিয়েই দাদি মারা গেলেন। কিন্তু বাবার কপালে শান্তি বেশিদিন টিকল না। আমার জন্ম হওয়ার সময় মা মারা গেলেন। ব্যাস! আবার শুরু হয়ে গেল রাত ১২টা বাজতেই বারান্দায় হাঁটাহাঁটি...

আমাকে থামিয়ে দিয়ে জামিল হায়দার বলল, "কিন্তু আপনার এই পারিবারিক ভৌতিক কাহিনীর সাথে ভাবীর পলায়নের যোগসুত্র কোথায়?"

আমি দু সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললাম, “জামিল ভাই, আপনি একটা জিনিস জানেন যে আমি কথার মাঝখানে কথা বলা পছন্দ করিনা। আপনি যদি কথা বলতে চান, বলে যান আমি শুনছি। কিন্তু যদি আমার মুখে কিছু শুনতে চান, দোয়া করে চুপ করে থাকবেন!”

জামিল হায়দার ভাতের লোকমা মুখে দেয়ার ফাঁকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বলল, “ওকে ভাই! বলতে থাকেন! আমি আর বাঁধা দিচ্ছি না!”

আবার শুরু করলাম আমি-

“মায়ের মৃত্যুর পর বাবা আবার সেই জ্যোতিষীর কাছে গেলেন। জ্যোতিষী তখন বুড়ো থুড়থুড়ে হয়ে গেছেন। ঠিক মত কোথাও বলতে পারেন না। আমাকে দেখিয়ে বললেন, ‘তোর ছেলে বড় হয়ে বিয়ে করে যেদিন ঘরে বউ আনবে সেদিন থেকে আবার ঐ অশরীরী আত্মা বিদায় নেবে’। আমি কিন্তু ছোটবেলা থেকে ঐ হাঁটার শব্দ শুনে শুনেই বড় হয়েছি। ব্যাপারটাতে আমি একদমই ভয় পেতাম না। বরং আমার কাছে মজাই লাগত! ভুতের সাথেই যার বসবাস, সে ভুতকে আর কি ভয় পাবে বলুন?” এই পর্যন্ত বলে আমি হো হো হো করে কিছুক্ষন হাসলাম।

জামিল হায়দারও একটু অপ্রস্তুতভাবে হাসল। এখন মনে হচ্ছে আমার কথা খানিকটা বিশ্বাস করছে লোকটা।

যেমন হঠাৎ শুরু করেছিলাম ঠিক তেমনি হঠাৎ করেই হাসি থামিয়ে দিলাম আমি। কয়েক সেকেন্ড বিরতি। জামিল হায়দারের খাওয়া শেষ পর্যায়ে, ঘটনাটা তার আগেই বলে শেষ করা প্রয়োজন! আমি আবার বলা শুরু করলাম-

আমি বড় হলাম, পড়াশুনা শেষ করলাম। একটা ভাল চাকরী পাওয়ার সাথে সাথেই বাবা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য তড়িঘড়ি শুরু করলেন। বিষয়টা আমার ভাল লাগছিল না। আমি আরও সময় নিতে চাইছিলাম সব কিছু গুছিয়ে ওঠার জন্য। কিন্তু বাবা উঠে পড়ে লাগলেন ভুত তাড়ানোর জন্য। জ্যোতিষীর সেই বানী বাবা কখনও ভুলেন নি। আমার স্ত্রী বাড়িতে পা দিলেই বারান্দায় বসবাসকারী ঐ অশরীরী আত্মা নাকি পালাবে!
বাবা ডজনখানেক মেয়ে দেখে অবশেষে সোনিয়াকে পছন্দ করলেন আমার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য। সোনিয়া কে বুঝেছেন তো? আপনার ভাবী!
“জি বুঝেছি”। জামিল হায়দার প্রবলবেগে হ্যা-বোধক মাথা নাড়ল। গল্প ক্লাইমেক্সে পৌঁছেছে দেখে খাওয়া ভুলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
জ্যোতিষীর ভবিষ্যৎবানী আবারও সঠিক প্রমানিত হল! সোনিয়া যে রাতে বাসায় এল সে রাত থেকে ঐ অদ্ভুত খস খস শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। বাবা হাফ ছেলে বাঁচলেন। সোনিয়া নিন্ম-মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধাসিধে মেয়ে। খুব বেশি চাহিদা নেই তার। আমার সংসারটাকে অল্প কদিনেই গুছিয়ে নিল। পতিভক্তি, শ্বশুরভক্তি, সংসারসেবা- আদর্শ বাঙালী গৃহবধূ। সংসারে আছে সুখের সকল উপাদান। দারুণ কাটছিল দিনগুলি। সব কিছুই ঠিক ছিল, শুধু একটা জিনিস বাদে!”

এই পর্যন্ত বলে থামলাম আমি। প্রায় সাথে সাথেই জামিল হায়দার প্রশ্ন করল, তার আর শেষটুকু শোনার তর সইছে না। “কি জিনিস নাজিম ভাই? কি ঠিক ছিলনা?”

“বলছি জামিল ভাই, একটু সবুর করেন”। বলে আমি এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলাম। ইচ্ছে করেই জামিল হায়দারের উত্তেজনা বাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। মৃদু হেসে বললাম, “সব ঠিক থাকলেও একটা জিনিসের অভাব ছিল বাড়িতে”।

“কিসের অভাব?”

“ঐ পায়ের আওয়াজের অভাব বোধ হচ্ছিল খুব!”

“কি বলছেন আপনি?” অবাক হল জামিল হায়দার। “আপনারাতো সারাজীবন আশা করে এসেছেন যে এক সময় ঐ পায়ের আওয়াজ দূর হয়ে যাবে আপনাদের বাড়ি থেকে। আজ যখন সেটা দূর হয়েছে, তার অভাব বোধ হবে কেন?”

"ভুল বললেন জামিল সাহেব"। আমি মুখের হাসিটা ধরে রেখেছি। "আমার দাদি চাইত ঐ আওয়াজ চলে যাক, বাবাও চাইতেন কিন্তু আমি চাইতাম না!"

"তার মানে?"

আমি বুঝানোর চেষ্টা করলাম- “একবার চিন্তা করে দেখেন জামিল ভাই। আপনি ছোটবেলা থেকে প্রতিনিয়ত পেয়ে অভ্যস্ত এমন একটা জিনিস যদি হঠাৎ আপনার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে কি আপনার ভাল লাগবে? লাগবে না! আমারও লাগত না!”

জামিল হায়দার নাছোড়বান্দার মত বলছে, “কিন্তু সেটা তো ঘটে প্রিয় কোন বস্তুর ক্ষেত্রে! এটা একটা ভয়ের ব্যাপার! সবাই চাইবে এটা দূর হোক!”

“আবার ভুল করছেন আপনি। আমি কিন্তু একবারও বলিনি ঐ শব্দ শুনে আমার ভয় লাগত! আমি প্রতিরাতে ঐ শব্দ শুনে শুনে ঘুমাতাম। আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। অভ্যাস না বলে আসক্তি বলতে পারেন। যেদিন থেকে ঐ আওয়াজ দূর হয়ে গেল, সেদিন থেকে রাতের বেলা আমার আর ঘুম আসত না!”

“তারপর?”

“তারপর আর কি? যে কারনে আওয়াজ আসত না সে কারণ দূর করার চেষ্টা করলাম!”

“এবার বুঝেছি!” উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেল জামিল হায়দার! “এবার বুঝেছি কেন সোনিয়া ভাবীর মত এমন ভাল মানুষ ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন! কষ্টে! আপনি নিশ্চয়ই সোনিয়া ভাবীর ওপর অনেক অত্যাচার করেছেন জাতে উনি পালিয়ে যেতে বাধ্য হন!”

আবার ভুল করছেন মশাই! আমি হাসি মুখে বললাম। “আপনি দয়া করে বসুন, আমি বুঝিয়ে বলছি!”

জামিল হায়দার নিতান্ত অনিছা সত্ত্বেও বসল। রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। আমি বললাম, “আমি কি একবারও বলেছি যে আপনার ভাবী পালিয়ে গেছে?”

“পালায় নি! আপনি তাড়িয়ে দিয়েছেন!”

“কোনটাই ঠিক নয়!”

“তাহলে কি ঠিক?”

আমি দার্শনিকের মত বললাম, “হতে পারে সে হয়ত এ বাড়িতেই আছে। অথবা কোথাও নেই!”

“অসম্ভব! আপনার বাড়ি থেকে ভাবীকে ব্যাগ ব্যাগেজ সহ দৌড়ে বেড়িয়ে যেতে দেখা গেছে! সবাই ধরে নিয়েছে ভাবী পালিয়ে গেছেন!

“তাই নাকি? লোকে ধরে নিলেই তা সত্যি হয়ে যাবে?”

“লোকে মিথ্যা ধরবে কেন?”

আমি কৌতুক বলার মত করে বললাম, “আপনি যে মগজভুনা দিয়ে মজা করে ভাত খাচ্ছেন, আমি তো একবারও বলিনি যে ওটা গরুর মগজ ভুনা! কিন্তু আপনি তো ঠিক তাই ধরে নিয়েছেন! তাই বলে কি তাই সত্যি?

আমার দিকে এক মুহূর্ত নিশ্চুপ থাকিয়ে থাকল জামিল হায়দার! তারপর মুখ খুলল, তোতলাচ্ছে- “তা... তারমানে? এ... এই মগজ কিসের? গ... গরুর মগজ তো খেতে এমন হয় না!”

আমি মুচকি হেসে বললাম, “আপনার ভাবীর গুনের কোন শেষ নাই জামিল ভাই! আজ আরও একটা গুন আবিষ্কার করলাম আমরা দুজনে মিলে! কি বলেন?”

জামিল সাহেব চেয়ার ঠেলে উঠে দাড়ালেন, মুখটা রক্তশুন্য ফ্যাঁকাসে দেখাচ্ছে। চোখ মুখ কুঁচকে চেহারায় অদ্ভুত এক বিকৃত ভাব। ভেতর থেকে ঠেলে আসা বমি অনেক কষ্টে আটকানোর চেষ্টা করলে যেমন হয়! এরই ফাঁকে বলতে থাকলেন, “আ... আপনি একটা স্যাডিস্ট! আ... আপনি একটা সাইকো! আ... আমি বলে দেব! স... সব বলে দেব! পুলিশকে সব কিছু বলে দেব!”

“তাই নাকি? সব বলে দেবেন?” আমার চোখে কৌতুক খেলা করছে।

“হ্যা হ্যা বলে দেব!”

আমি টেবিলের ওপর রাখা ফল কাঁটার ছুড়িটা হাতে তুলে নিলাম। এক হাতে ছুরিটার ধার পরিক্ষা করছি। যদিও ফল কাঁটার ছুড়ি, কিন্তু চাইলে এটা দিয়ে অনেক কিছুই করা যায়! জামিল হায়দার আমার দিকে

আতংকিত চোখে তাকিয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম-
“জামিল সাহেব? আপনি কি এখানে আসার আগে কাউকে বলে এসেছেন?”

জামিল হায়দারের মুখটা রক্তশূন্য ফ্যাঁকাসে আকার ধারণ করল। চোখদুটো
বলছে- সে এখানে আসার আগে কাউকে বলে আসেনি!

“আপনি এত ভয় পাচ্ছেন কেন জামিল ভাই?” আমি ছুরিটা আবার টেবিলের উপর নামিয়ে রাখলাম। মুখে সপ্রতিভ হাসি। বললাম, “আপনি পুলিশকে কি বলে দেবেন? বলার মত এখানে আছে টা কি?”

জামিল হায়দারের চোখ মুখ একটু উজ্জ্বল হল এবার! “আপনি এতক্ষন আমার সাথে মশকরা করেছেন তাইনা নাজিম ভাই?”

আমি কিছু না বলে ঠোঁট টিপে হাসছি। মৌনতাই সম্মতির লক্ষন!

জামিল হায়দার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। “ওহ! নাজিম ভাই! আপনি পারেনও! ভয়ে জান উড়ে গিয়েছিল আমার”! জামিল হায়দার আবার পায়ে
পায়ে হেঁটে এসে চেয়ার টেনে বসল। “এটা ঠিক যে আমি আপনাকে সব সময় এটা ওটা প্রশ্ন করে জ্বালাই। তাই বলে এভাবে ভয় দেখাবেন আমাকে?”

আমি মুখে হাসিটা ধরে রেখেছি।

আরও কয়েক সেকেন্ড কেটে গেল।

তারপর...

ঘড়িতে বাজে ঠিক ১২টা!

ঠিক এসময় মত বারান্দা থেকে ঐ খস খস শব্দটা আবার ভেসে এল, কেউ যেন পা টেনে টেনে হাঁটছে। আহ! বড় শান্তি লাগে এই শব্দ শুনতে পেলে!
আমি আবার ফল কাঁটার ছুরিটা হাতে নিলাম। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি জামিল হায়দারের দিকে। আমার চোখদুটো এখন অদ্ভুত এক আনন্দ লাভের আশায় চক চক করছে!

জামিল হায়দার আবারও ভুল করেছে! মৌনতাকে সব সময় সম্মতির লক্ষন ধরে নেয়া ঠিক নয়!

(সমাপ্ত)
1 like ·   •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 30, 2015 22:38

January 30, 2015

দ্যা পেইন্টার (শেষ অংশ)

প্রথম পর্বের লিংকঃ
দা পেইন্টার

ছয়

ইকবাল খান জানত না এই কেস কেবল শুরু হয়েছে। ক্লোজড হওয়ার পথ এখনও অনেক দূর। এটেম্পট টু মার্ডার কেসে মারুফ দোষী সাব্যস্ত হল কিন্তু পূর্বের ঘটনা যা যা ঘটেছে তার সাথে মারুফকে সম্পৃক্ত করার মত যথেষ্ট প্রমাণাদি পাওয়া গেলনা। শেফালীর তেমন কোন ক্ষতি হয়নি বলে মাত্র দুই মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হল মারুফকে।

মারুফের কারাদণ্ড শুরু হওয়ার কয়েক দিন পরের কথা...

এক মাঝি সকাল বেলা নৌকা নিয়ে বের হয়েছে। সে নদীর জলে একটা মেয়ে ক্ষত বিক্ষত লাশ ভাসতে দেখল। ঠিক যেমনটি এঁকেছিল মারুফ তার ছবিতে। পুলিশ এসে লাশটা উদ্ধার করল। অটোপসি রিপোর্টে দেখা গেল প্রচণ্ড পাশবিক নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে শেফালীর। মৃত্যুর পর লাশটা ফেলে দেওয়া হয়েছে পানিতে।

পরবর্তী একমাস ঘুম ছুটে গেল ডিটেকটিভ ইকবাল খানের। কিছুতেই রহস্যের কূল কিনারা মিলছে না। আশরাফ রবিন ও ইকবাল খানের ধারনা ছিল কাজগুলো মারুফ নিজেই করে কিন্তু মারুফ জেলে থাকা অবস্থায় এই ঘটনা প্রমাণ করে দিল যে তাদের ধারনা অমূলক। তবে কি আসলেই মারফের কোন অলৌকিক কোন ক্ষমতা আছে?

যথারীতি দু মাস কাটতেই মারুফ ছাড়া পেয়ে গেল।

এদিকে আশরাফ রবিনের চোখেও ঘুম নেই। দিন রাত শুধু একটাই চিন্তা- কিছু একটা বোঝার ভুল হয়েছে তার! কিছু একটা চোখ এড়িয়ে গেছে! কিন্তু ভুলটা আসলে কোথায় হল? এসময় সে মারুফ ও হাসান দুজনের সাথেই কথা বলল। মারুফের আঁকা ছবিগুলো নিয়ে অনেক স্টাডি করল, ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করল, একসময় সমাধানটা চোখে পড়ল।

পোষ্ট মর্টেমকারী একজন ডাক্তার শেফালীর ডান হাতের নখের নিচে অন্য কারো খানিকটা চামড়ার অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন। সম্ভবত নিজেকে বাঁচানোর প্রচেষ্টায় টর্চারকারী ব্যক্তিকে সে খামচি দেয়ার চেষ্টা করেছিল। আশরাফ রবিনের পরামর্শে তদন্তকারী গোয়েন্দারা নখের নিচের পাওয়া এই চামড়ার সাথে শেফালীর হবু বর হাসানের ডিএনএ মেলে কিনা সেটা টেস্ট করে দেখল। ফলাফলটা হল চমকে যাওয়ার মত! ডিএনএ টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ! অর্থাৎ হবু বর হাসানের হাতেই শেফালীর নৃশংস মৃত্যু হয়েছে!


"সাত"

“তুই কি ডিএনএ ম্যাচ করার আগেই বুঝতে পেরেছিলি যে কাজটার পেছনে হাসানের হাত আছে?”

“নিশ্চিত ছিলাম না। একটা ঝাপসা মত ধারনা করতে পেরেছিলাম”। বলল রবিন। “কিন্তু এই ডিএনএ টেস্ট ছাড়া তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করার মত কোন প্রমান ছিলনা”।

“কীভাবে এটা সম্ভব হল বল তো?” এখনও ডিএনএ টেস্টের রেজাল্ট দেখার চমক কাটেনি ইকবাল খানের! “ হাসান নিজেই আমাদের কাছে শেফালীর নিরাপত্তার জন্য এসেছিল! তাছাড়া সে শেফালীকে ভালবাসত। কেন সে শেফালীকে মারতে চাইবে?”

“সে কথায় পরে আসছি। আগে ব্যাপারটা প্রথম থেকে খুলে বলি। যদিও এখনও অনেক প্রশ্নের জবাব আমি পাইনি, কিন্তু কিছু বিষয় চোখের সামনে পরিষ্কার...”

দুই বন্ধু বসে আছে বাংলাদেশ পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের হেডকোয়ার্টারে। হাসানকে খুনের অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্তের চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়ার আগে একবার রবিনের সাথে পরামর্শ করে নিচ্ছে ইকবাল খান।

রবিন বলে চলেছে, “... মারুফ আর হাসান ছোটবেলা থেকেই একসাথে বড় হয়েছে, দুজনে খুব ভালো বন্ধু, কিন্তু হাসান সবসময় মারুফকে অনুকরণ করার চেষ্টা করত। মারুফের ছবি আঁকার প্রতিভাকে সে হিংসা করত। তাই সে চাইত না মারুফ ছবি এঁকে মানুষের প্রশংসা কুড়াক।
...সম্ভবত প্রথম যে ঘটনাটি ঘটেছিল তাদের গ্রামে, জালাল নামের একটি ছেলেকে হাত পা ভাঙা অবস্থায় আম গাছের নিছে পাওয়া গিয়েছিল, তা ছিল একটা কাকতালীয় ঘটনা। জালালকে অন্য কেউ এসে মেরে রেখে গিয়েছিল যা মারুফের আঁকা ছবির সাথে মিলে যায়! কিন্তু ঘটনাটা হাসানের মনে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।
... মারুফের মনে এক ধরনের ফ্যান্টাসি কাজ করত। সে কারো ওপর রেগে গেলে তার অনিষ্ট কামনা করে ছবি আঁকত। ব্যাপারটা হাসানের জানা ছিল। ছবিতে কখনও দেখা যেত কারো হাত পা ভেঙে গেছে, কেউ মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়েছে, এমনকি মৃতদেহের ছবিও সে আঁকত। মারুফ যদিও বলছে সে অবচেতন মনে ছবিগুলো আঁকে কিন্তু আমার মনে হয় কিছু কিছু ছবি সে ইচ্ছে করে এঁকেছে। কারণ তার নিজের ধারনা তার আঁকা ছবিগুলো ভবিষ্যতে বাস্তব হবেই। এখানেই সুযোগটা খুঁজে পেয়েছে হাসান।
... আগেই বলেছি হাসান চাইত না মারুফের ছবি আঁকার অসাধারণ প্রতিভার কথা মানুষ জানুক। তাই সে গোপনে গোপনে মারুফের আঁকা ছবিগুলো সত্যি প্রমাণিত করার চেষ্টা করত। এর ফলে মারুফের মনে ধারনা জন্মাল তার এই ছবি আঁকার ক্ষমতা এক ধরনের অভিশাপ। তাই মারুফ ছবি আঁকা ছেড়ে দিল। হাসানের কুটিল ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে এদেশের এক অসাধারণ প্রতিভা সব সময় লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেল!
... আরও একটা ইন্টারেস্টিং তথ্য জানাই তোকে, হাসান আমাদেরকে মারুফের ছবি আঁকার ক্ষমতার কথা বলেছে কিন্তু যে বিষয়টি গোপন করে গেছে তা হল সে নিজেও চমৎকার ছবি আঁকতে পারে। বললাম না সে সব কাজে মারুফকে অনুসরণ করত? তাই গোপনে গোপনে একজন বিখ্যাত চিত্র শিল্পীর কাছে সে ছবি আঁকা শিখেছে। হতে পারে মারুফ ছবি আঁকা ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে ব্ল্যাক আউট হয়ে ছবি আঁকার ব্যাপারটা আসলে ভুয়া। হাসান তার অজান্তে ছবি এঁকে রাখত, আর মারুফ ভাবত সে নিজে ব্ল্যাক আউটের সময় ছবিটা এঁকেছে! এভাবে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য মারুফ নিজের ছবি আঁকার ক্ষমতাকে দায় করেছে কিন্তু ফায়দা লুটেছে হাসান।
... আমি ধারনা করছি মারুফ আর শেফালীর মধ্যে এক সময় প্রেমের সম্পর্ক ছিল যা হাসান জানত না। কিন্তু শেফালীর বাড়ি থেকে হাসানের সাথে তার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর ব্যাপারটা হাসান জানতে পারে। যেহেতু সব কাজে মারুফকে সে হিংসা করত তাই মারুফের প্রতি শেফালীর টান হাসান মেনে নিতে পারেনি। একদিন মারুফের অজান্তে হাসান শেফালীর মৃতদেহের ছবি আঁকে। মারুফ ধারনা করে ছবিটা তার নিজের আঁকা। আরও একবার মারুফের ছবি আঁকার ক্ষমতাকে অভিশাপ হিসেবে দেখানোর সুযোগ পেয়ে গেল হাসান।
... এসবই আসলে আমার ধারনা! জোর দিয়ে বলার মত নিরেট কোন প্রমাণ হাতে পাইনি”।

“কিন্তু একটা জিনিস এখনও পরিষ্কার হচ্ছেনা”। রবিন একটু থামতেই ইকবাল খান বলল। “হাসান কেন পুলিশের সাহায্য চাইল শেফালীকে বাঁচানোর জন্য?”

“এই প্রশ্নের সরাসরি কোন কোন উত্তর দেয়া সম্ভব নয়”। মাথা নাড়ল রবিন। “সম্ভবত হাসানের মনের একটা অংশ চাইছিল শেফালীকে বাঁচাতে। হতে পারে তার মধ্যে একটা দ্বৈত স্বত্বার বাস! তাই পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছিল”।

“তাহলে বল হাসান কেন এমন একটা সময় শেফালীকে খুন করল যখন মারুফ জেলখানায় বন্দী?” আবার রবিন কে লক্ষ করে প্রশ্ন ছুঁড়ল ইকবাল খান। “সে যদি মারুফের জেলমুক্তির পর শেফালীকে খুন করত তাহলে আমাদের সব সন্দেহ মারুফের ওপর গিয়ে পড়ত। মারুফকে ফাঁসিয়ে দেয়ার এমন চমৎকার সুযোগ হাসান কেন হাতছাড়া করল?”

“বললাম তো অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনও পাইনি আমি”। বলল রবিন। “তবে ধারনা করতে পারি যে এখানেই মানসিক অসুস্থতার প্রসঙ্গটি চলে আসছে! হাসান মারুফকে যতই হিংসা করুক। তারা আসলে খুব কাছের বন্ধু! তারা দুজনে ছিল দুই দেহে এক আত্মার মত। আমাদের সন্দেহের হাত থেকে মারুফকে বাঁচানোর জন্য সে খুনটা ঐ সময় করেছে। যেন আমরাও ধারনা করে বসি মারুফের অলৌকিক কোন ক্ষমতা রয়েছে! মারুফ ও হাসান এঁকে অপরের প্রতি অবসেসড। তাদের বন্ধুত্ব বন্ধুতা ছাড়িয়ে মানসিক অসুস্থতার পর্যায়ে চলে গেছে। তারা দুজন এক সাথে থাকে, এক সাথে চলে, একসাথে খায়, এক ভাবে চিন্তা করে, একে অপরকে ছাড়া চলতে পারেনা”।

“কিন্তু তুই যা যা বলছিস এগুলো সবই নিছক ধারনা! কোন নিরেট প্রমাণ ছাড়া পুলিশ এক পাও এগোতে পারবে না। আমরা হাসানকে শুধু শেফালীর খুন ছাড়া আর কোন অপরাধের সাথে জড়াতে পারছি না। অবশ্য তার ফাঁসি হয়ে যাওয়ার জন্য ঐ একটা অপরাধই যথেষ্ট”! এক মুহূর্ত থেমে থেকে আবার ইকবাল প্রশ্ন করল রবিনকে। “আমার রিপোর্টের ব্যাপারে তোর কি কোন সাজেশন আছে?”

“আমার মনে হয় রিপোর্টে তোর উচিৎ হাসানকে মানসিক রোগী হিসেবে দেখানো”! বলল রবিন। “কেন যেন মনে হচ্ছে এর ভেতরে আরও কিছু ব্যাপার রয়ে গেছে যা আমাদের নজরে পড়ছে না। সে যে কাজ গুলো করেছে তা কোন স্বাভাবিক চিন্তা-বুদ্ধি সম্পন্ন লোকের পক্ষে করা সম্ভব নয়! তার মত একজন সাইকোলজিকাল ডিসঅর্ডারে ভোগা মানুষের চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন”!

"আট"

বাগান বাড়ির বারান্দায় দাঁড়ালে একে বেঁকে এগিয়ে চলা যে পথের দেখা পাওয়া যায় মারুফ তার নাম দিয়েছে আপনহারা পথ। তার ধারনা এ পথে হাঁটলে আপন মানুষেরা হারিয়ে যায়। সবুজ ঘাসের বুক চিড়ে এগিয়ে চলা এক মেঠো-পথ এগিয়ে গেছে বহুদূর!

শহরের বাইরে এই বিশাল রাজ প্রাসাদের মত দেখতে বাগানবাড়িতে মারুফ সম্পূর্ণ একা। মারুফের এক চাচা এই বাড়ির মালিক। ভদ্রলোক পরিবার নিয়ে দেশের বাইরে থাকেন বলে বাড়িটা প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থাতে পড়ে আছে। মারুফ আর হাসান প্রায়ই এসে কিছুদিন থেকে যায় এখানে। কিন্তু আজ মারুফের পাশে হাসান নেই, সে পুলিশের হাতে বন্দী।

প্রিয় বন্ধুকে ছাড়া খুব একা লাগছে মারুফের। এতটা নিঃসঙ্গতা তাকে আগে কখনও গ্রাস করতে পারেনি। ছোট বেলা থেকে এক সাথে বেড়ে উঠেছে দুজন! কত অসংখ্য ঘটনা জমে আছে স্মৃতির পাতায়!
২০ বছর আগে...

স্কুল ছুটির পর হাসানকে ডেকে একপাশে নিয়ে গেল মারুফ। “হাসান, আমাকে বাঁচা। একটা সমস্যা হয়ে গেছে”!

“কি সমস্যা?”

“সেদিন জালালের হাত পা ভাঙা অবস্থার যে ছবি এঁকেছিলাম, সেই খবর জালাল জেনে গেছে”।

“কি বলিস?” হাসানের চোখে ভয় ফুটে উঠল।

“জালাল আমাকে বলেছে আজ বিকেলে ঐ বড় আমগাছের নিচে দেখা করতে। একটা জরুরী বিষয়ে নাকি কথা বলবে”!

“কথা বলবে না মারুফ! ও তোকে পিটাবে। তুই ছবিতে জালালকে যেভাবে পড়ে থাকা দেখিয়েছিস। জালাল তোকে পিটিয়ে ঠিক সেভাবেই ফেলে রাখবে”।

“আমি জানি। এজন্যই তো সে আমাকে আমগাছের নিচে ডেকেছে! কিন্তু এখন উপায় কি?”

“দরজা আঁটকে বাসায় বসে থাকবি। ভুলেও ওদিকে যাবিনা”!

“কিন্তু তুই তো জালালকে চিনিস! আজ যদি আমি না যাই তাহলে পরে আমাকে একলা পেলে আরও বেশি মারবে”।

“পরেরটা পরে দেখিস। এখন থেকে একলা বাইরে বের হওয়া বন্ধ করে দে। সব সময় বড়দের সাথে চলা ফেরা করবি। কদিন বাদেই দেখবি ঘটনাটা জালাল ভুলে গেছে”!

হাসানের পরামর্শটা মারুফের পছন্দ হলনা। জালাল সহজে বিষয়টা ভুলবে না, আজ না হোক কাল, এক সময় শোধ তুলবেই। কতদিন সাবধানে বড়দের সাথে চলাফেরা করবে সে? মারুফ সিদ্ধান্ত নিলো জালালের সাথে দেখা করবে। জালাল কিছু বলার আগেই তার পা চেপে ধরে মাফ চাইবে। এছাড়া বাঁচার আর কোন উপায় নেই।

বিকেল বেলা মারুফ সাহস করে বাসা থেকে বের হল। গাঁয়ের মসজিদের সামনের রাস্তা ধরে সোজা হেঁটে গেলে শেষ মাথায় বড় আমগাছটা পড়ে। মসজিদ পার হয়ে এসে বড় রাস্তায় উঠতেই সামনে হাসানকে দেখতে পেল মারুফ। হাসানের হাতে একটা মোটা লাঠি! ঘটনা কি?

আমগাছের কাছ পর্যন্ত গিয়ে রাস্তা ছেড়ে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে গেল হাসান। মারুফও তার দেখাদেখি লুকিয়ে পড়ল। বিষয়টা তার বোধগম্য হচ্ছেনা। হাসান ঝোপের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। জালাল এদিকে পেছন ফিরে বড় রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে।
মারুফ দেখল হাসান নিঃশব্দে একেবারে পেছনে গিয়ে হাতের লাঠিটা জালালের মাথায় সজোরে নামিয়ে আনল! প্রায় সাথে সাথেই মাটিতে পড়ে গেল জালাল। আর নড়া চড়া করছে না সে। সম্ভবত অজ্ঞান হয়ে গেছে! নাকি মরেই গেল। জালালের নিস্তেজ দেহটাকে লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করল হাসান। মারুফ দৌড়ে এসে থামাল হাসানকে। হাসানের চোখে মুখে এখন অন্যরকম এক অভিব্যক্তি। এই দৃষ্টির অর্থ মারুফের জানা নেই। সে ধাক্কা দিয়ে মারুফকে সরিয়ে দিল। তারপর লাঠিটা মাটিতে ফেলে বড় রাস্তা ধরে দৌড় লাগাল। পালাচ্ছে সে। মারুফ বুঝল তারও পালান দরকার। কিন্তু বন্ধুর ওপর সে খুব কৃতজ্ঞ বোধ করছে। মারুফের বিপদ দেখে হাসান কত্ত বড় ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে এসেছে!

পরদিন হাসান স্কুলে যেতেই দেখল সব বাচ্চারা তাকে ভয় পাচ্ছে! কেউ সাহস করে কাছে আসছে না! তার আঁকা ছবি সত্য হয়েছে, এই ঘটনার কথা সবার কানে পৌঁছে গেছে! হাসান হঠাৎ প্রায় দৌড়ে এসে বলল, “মারুফ তুই আর ছবি আঁকবি না! তোর ছবি আঁকার হাত অভিশপ্ত!”
“কি বলছিস?”

“হ্যা, তুই ছবি এঁকেছিস বলেই তো জালালের এই অবস্থা হয়েছে”!
“আমার জন্য এই অবস্থা হয়েছে? গতকাল বিকেলের কথা কি ভুলে গেছিস? কোথায় ছিলি তুই?”

“কেন ভুলব? বাসাতেই ছিলাম”!

মারুফ ভাবল হাসান হয়ত দায় এড়ানোর জন্যই মিথ্যা বলছে। তবুও বন্ধুর প্রতি সে কৃতজ্ঞ বোধ করছে! বড় একটা বিপদ থেকে তাকে বাঁচিয়েছে হাসান।

কয়েকদিন পার হয়ে গেল। গ্রামের ছেলে মেয়েরা এখন আর মারুফের সাথে মেশেনা। সবাই তাকে ভয় পায়। এমনকি জালালও তাকে ভয় পেয়ে এড়িয়ে চলে। এখন তার একমাত্র বন্ধু হাসান! অবশ্য সেদিন বিকেলের কাণ্ড নিয়ে হাসান আর মারুফের মাঝে আর কোন কথা হয়নি।

একদিন চুরি করে নরহরি কাকার দোকান থেকে মিষ্টি খেতে গিয়ে ঘটল আরেক বিপত্তি। সারা গ্রামে দুজনে চোর অপবাদ পেয়ে গেল। এবার নরহরি কাকার একটা ছবি আকল মারুফ। এক চোখে গেঁথে আছে একটা কাটা চামচ। ছবিটা শুধু হাসানকে দেখাল মারুফ। আর কাউকে না।

পরদিন দুপুরে হাসানের সাথে দেখা করতে তার বাড়িতে গিয়েছিল মারুফ। বাড়ির গেট থেকে বেশ খানিকটা দূরে থাকতেই সে দেখল হাসান বাসা থেকে বেরিয়ে দ্রুত গতিতে কোথাও যাচ্ছে। নীরবে তার পিছু নিলো মারুফ। হাঁটতে হাঁটতে দুজনে বাজারে চলে এলো। নরহরি কাকা তখন অন্যান্য দিনের মত মিষ্টির দোকানে বসে ঝিমোচ্ছে। দুপুরবেলা আশে পাশে মানুষজন কম। দোকানে কাস্টমারও নেই।

হাসান নিঃশব্দে দোকানে ঢুকে পড়ে একটা কাটা চামচ হাতে তুলে নিলো। নরহরি কিচ্ছু টের পেলনা। মারুফ আড়ালে লুকিয়ে সবকিছু দেখছিল। আচমকা ক্ষিপ্র গতিতে কাঁটা চামচটা নরহরির এক চোখে বসিয়ে দিল হাসান। চোখের মধ্যে চামচের কাঁটা গুলো ঢুকে যাওয়ার এক বিচ্ছিরি শব্দ হল। নরহরি কাকা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু ততক্ষণে দোকান থেকে বেরিয়ে এসেছে হাসান। কোনদিকে না দেখে সোজা দৌড় লাগালো পালিয়ে যাওয়ার জন্য।

পরদিন হাসানের সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করল মারুফ। কিন্তু হাসান ভান করল যেন কিছুই জানেনা। এর পর এমন আরও কিছু ঘটনা ঘটার পর একটা সময় মারুফ বুঝতে পারল হাসান আসলে কাজগুলো করার পর ভুলে যায়! হাসান মনে প্রাণে বিশ্বাস করে মারুফের কোন অলৌকিক ক্ষমতা আছে। কিন্তু অবচেতন মন সে ধারনা সত্য প্রমাণের জন্য কাজ করে চলেছে।

আর একটু বড় হওয়ার পর হাসানের এই সমস্যার একটা নাম খুঁজে পেল মারুফ। ডুয়েল পারসোনালিটি! হাসানের মধ্যে দ্বৈত স্বত্বার বাস! ব্যাপারটা ধরতে পেরে ঘাবড়ে গিয়েছিল মারুফ। ছবি আঁকা ছেড়ে দিল। কিন্তু হাসানের এই মানসিক অসুস্থতার সুযোগ নিতে সে কখনও ছারেনি। হাসানের এই দ্বিতীয় সত্ত্বাটি প্রচণ্ড পরিমাণে বুদ্ধিমান ও অত্যন্ত কৌশলী। মারুফ যে ছবি আঁকে তা বাস্তব করা অসম্ভব হলেও সে ঠিকই একটা পথ খুঁজে নেয়! ফলে মারুফের জীবনে যারাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, ছবি এঁকে তাদেরকে সরিয়ে দেয়ার কাজটা সে খুব সচেতন ভাবেই করে চলেছে। ওদিকে হাসান জানেনা তার ভেতরের দ্বিতীয় সত্ত্বাটির রূপ যে কতটা ভয়ংকর!

বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মারুফের ঠোঁটের কোনে একটু হাসি খেলে গেল! আরও একজন বুদ্ধিমানের দেখা পেয়েছে সে। লোকটা হচ্ছে ড. আশরাফ রবিন! ঘটনার প্যাঁচে ফেলে লোকটাকে ঘোল খাওয়ানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেছে মারুফ। কিন্তু লোকটা সাইকোলজির শিক্ষক, ঠিকই গন্ধ শুকে শুকে সমাধানের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে! এবার চূড়ান্ত একটা ব্যবস্থা না নিলে ঝামেলা হয়ে যেতে পারে!

"নয়"

মারুফের বিরুদ্ধে এটেম্ট টু মার্ডারের কেস করার পর তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র সব পুলিশ কাস্টডিতে আনা হয়েছিল প্রমাণ সংগ্রহের জন্য। তার মধ্যে একটা পুরনো ডায়েরী ছিল। ডায়েরীটা রবিন নিয়ে এসেছে পড়বে বলে। তারপর মনের ভুলে ফেলে রেখেছিল ডেক্সের ওপর। মাঝখানে ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষার খাতা দেখা নিয়ে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এখন অবসর হতে ডায়েরীটা চোখে পড়েছে।

হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখল রবিন। ডায়েরীর বেশির ভাগ পৃষ্ঠাই খালি। কয়েক যায়গায় কলম দিয়ে স্কেচ এঁকে ফুটিয়ে তুলেছে দুর্দান্ত কিছু ছবি। তবে মাঝে মধ্যে মুক্তগদ্যের মত কিছু লেখা চোখে পড়ছে। ছেলেটার মধ্যে কাব্য প্রতিভাও ছিল! মুক্তগদ্য বিষয়টাকে কেমন যেন হেঁয়ালি মনে হয় রবিনের কাছে, খুব একটা বুঝতে পারেনা সে।

পুরো ডায়েরী উল্টে পালটে দরকারি কিছু না পেয়ে ফেরত দিবে বলে ভাবছিল রবিন, ঠিক তখনই একটা মুক্তগদ্যে চোখ পড়ল। গদ্যের ভেতর একটা যায়গায় “শেফালী” নামটা নজরে এসেছে তার। পুরোটা পড়তে শুরু করল সে...

আমার চোখের সামনে প্রায়ই ভেসে ওঠে এক চিরচেনা পথের ছবি। ভোরের প্রথম প্রহরে এই পথকে মনে হবে স্বর্গের সোপান! পথের শুরুতেই একপাশে চোখে পড়ে যুগল তালগাছ। সগর্বে ডানা মেলে তারা আকাশের বুকে মেঘেদের সঙ্গী হতে চায়। কিন্তু মাটি তো তাদের কিছুতেই ছাড়বে না, ভালোবাসার টানে বুকে বিঁধিয়ে রাখে তালগাছের সমস্ত শেকড়বাকড়। সবুজ মাঠের বুক চিরে এঁকে বেঁকে এগিয়ে চলা এই পথের একটা নাম দিয়েছি আমি- আপনহারা পথ। যে পথে আপন মানুষ হারিয়ে যায়! এই পথে এসে কতো প্রেমিক, কবি আর চিত্রকর যে শূন্য হয়ে গেলো তার খবর কেউ রাখেনি।

এই পথ আমাকে চিনিয়েছিলো এক গ্রাম্য কিশোরী, তার নাম শেফালী। শেফালী ছিল আমার মনের ক্যানভাসে আঁকা ছবির তুলি। এই তুলিতে এঁকেছিলাম জীবনের প্রথম শ্রাবণ। শেফালী তার সন্ধেবেলার পড়া ফেলে দুটি নগ্ন পায়ে কাদার আলতা মেখে এগিয়ে আসত এই পথ ধরে। আমি আকাশ থেকে বৃষ্টি হয়ে তার গায়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়তাম। দুজনে আলতো পায়ে হেঁটে জীবনের গল্পগুলো মাখিয়ে দিতাম সবুজ ঘাসের বুকে।

তবে একদিন শেফালী তার রূপ বদলে নিলো। আপনহারা ঐ পথ ধরে হেঁটে আসার সময় মেলে ধরল ছাতা, আমি সেদিন আর বৃষ্টি হয়ে তার গায়ে ঝরে পড়তে পারিনি। ছাতার গায়ে মাথা ঠুকতে ঠুকতে একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলাম পথের মাঝে। শেষ হয়ে গেল শ্রাবণ মেঘের সন্ধ্যা। এলো ঘরভাঙা রোদের দুপুর।

তবে শেফালী যে রোদের হাত ধরে বর্ষার দিনে কথা ভুলে গেল, সে জানেনা ঐ রোদ আসলে আমার আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের জ্বিন। আমি হুকুম করতেই সে জ্বিন সমস্ত পৃথিবীকে ওলট পালট করে দেয়! শেফালীকে রোদের সাথে মিলে এক হতে দেবনা আমি। একদিন তুলির আঁচরে লিখে দেব তার নৃশংস মৃত্যু! আমার জ্বিন তার মুণ্ডুটা টেনে ছিঁড়ে এনে চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে!

তারপর আমি কোনো এক নিঃসঙ্গ দুপুরবেলা একাই চলে যাব এ পথের শেষ মাথায়, যেখানে আমার এক রাজ প্রাসাদ আছে! যাওয়ার সময় বুক পকেট খালি রাখতে হবে, নইলে আপনহারা পথে মিশে থাকা শেফালীর শোকের ছায়া আমি কোথায় রাখব? আমাকে কেউ দেখতে পাবেনা। আমি আর আমার জ্বিন মিলে নতুন করে লিখব ঐ আপনহারা পথের ইতিহাস।

এর পর দ্রুত পাতা উল্টে অন্যান্য মুক্ত গদ্য গুলো পড়া শুরু করল রবিন। সবগুলো গদ্যতে আলাদীনের এক আশ্চর্য প্রদীপের জ্বিনের কথা বলেছে মারুফ। যে তার হয়ে সব ধরনের কাজ করে দেয়! রবিনের আর বুঝতে বাকি নেই যে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের জ্বিন বলতে সে আসলে হাসানের কথাই বুঝিয়েছে। এই মুক্তগদ্যগুলো আসলে এক একটা ছবি আঁকার আগের প্ল্যান! খুব চমৎকার ভাবে প্ল্যান করে নিজের জীবনের যত অপছন্দের মানুষ আছে তাদের অনিষ্ট করে বেড়াচ্ছে মারুফ।

ডায়েরী ফেলে ঝট করে উঠে দাঁড়াল রবিন! তার ধারনাই ঠিক! হাসানের মাঝে আসলেই দ্বৈত-সত্ত্বার বসবাস। অবচেতন মনে সে মারুফের আঁকা ছবি গুলো সত্য প্রমাণিত করছে ঠিকই কিন্তু সচেতন মন সে খবর পাচ্ছেনা। কিন্তু রবিন ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে সব কিছুর আড়ালে বসে কলকাঠি নাড়ছে মারুফ। হাসানের এই অসুস্থতার কথা জানে সে। এটাকে ব্যবহার করছে নিজের সুবিধার জন্য। সর্বশেষ শেফালীকেও সরিয়ে দিয়েছে তার ভালবাসা ফিরিয়ে দেয়ার অপরাধে!

এখন সব প্রশ্নের উত্তর খুব সহজেই মিলে যাচ্ছে! প্রথম থেকেই রবিনকে প্যাঁচে ফেলার জন্য অদ্ভুত সব চাল চেলেছে মারুফ! কিন্তু এইবার ধরা পড়ে গেছে!

দ্রুত মোবাইল বের করে ইকবাল খানের নম্বরে ডায়াল করল রবিন। কিন্তু কি বলবে সে? এই মুক্তগদ্য গুলো তো তার কথার প্রমাণ হিসেবে টিকবে না! নিরেট প্রমাণ সে দেবে কি করে?

"দশ"

জেলখানায় হাসানকে একা একটা সেলে রাখা হয়েছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে চিন্তা করলে বিলাসিতাও বটে! সেলের ভেতরকার অবস্থাও খুব একটা খারাপ না। একটা লোহার খাটিয়া, শক্ত তোষক সাদা চাদর, বালিশ শাহী আয়োজন। সেলের সাথেই একটা টয়লেট আছে ফলে যখন তখন প্রকৃতি ডাকলেও সাড়া দিতে সমস্যা হবে না। ঠিক ভিআইপি না হলেও সেমি ভিআইপি কারাগার বলা চলে।

হাসান ভেবে পায়না তাকে এমন একটা সেলে রাখা হয়েছে কেন? খুব ভায়োলেন্ট টাইপের কয়েদীদের সাধারণত এভাবে অন্যান্য কয়েদীদের থেকে একটু আলাদা রাখা হয়। বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয় যেন উলটা পালটা কিছু করার চিন্তা মাথায় আসার অবকাশ না পায়। তবে কি তাকে ভয়ংকর ঠাণ্ডা মাথার খুনি হিসেবে ট্রিট করা হচ্ছে?

আপন মনে একটু হাসল হাসান। শুনেছে খুব দ্রুত তাকে একটা আধা সরকারি মানসিক ইন্সটিটিউশনে ট্রান্সফার করা হবে। সে নাকি কঠিন একটা সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডারে ভুগছে! মানুষের খোলসের আড়ালে মাঝে লুকিয়ে আছে এক অমানুষ! যেকোনো মুহূর্তে বেরিয়ে এসে সব কিছু ধ্বংস করে দেবে। পাগলে বিশ্বাস কি?

“মাহমুদুল হাসান”!

নাম ধরে ডাক শুনে চমকে উঠল হাসান। গভীর চিন্তায় নিমগ্ন থাকায় কারো হেঁটে আসার শব্দ শুনতে পায়নি সে। উত্তর দিল। “জী?”

“তোমার জন্য একটা চিঠি এসেছে”! বলল সেলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ডিউটি অফিসার।

“ধন্যবাদ স্যার”। হাত বাড়িয়ে চিঠিটা ধরল হাসান। খামের ওপর প্রেরকের নামটা পড়ল- মারুফ মুক্তাদির। খামটা খোলাই আছে। তার কাছে দেওয়ার আগে চিঠিটা খুলে পড়ে দেখেছে জেল কর্তৃপক্ষ। চিঠিটা বের করল হাসান। খুব সংক্ষিপ্ত চিঠি...

হাসান,

আমি জেলখানায় তোর সাথে একবারও দেখা করতে আসিনি দেখে তুই হয়ত খুব অবাক হচ্ছিস। কেন আসিনি সেই কারনটা শোন- আমি তোকে ঘৃণা করি মারুফ। কেমন করে পারলি শেফালীর মত নিষ্পাপ একটা মেয়েকে এভাবে খুন করতে? সারাটা জীবন তুই আমাকে ধোঁকা দিয়ে এসেছিস! আমার ছবি আঁকার প্রতিভা সবার কাছ লুকিয়ে রেখে তোর কি লাভ হল?

তোর মানসিক অসুস্থতা আমি মানিনা। আমি প্রার্থনা করি যেন তোর খুব কঠিন শাস্তি হয়।

ইতি
মারুফ মুক্তাদির


কাগজের খালি যায়গাতে হাত বুলাতেই চিকন করে কাঁটা মোম ঘষে ঘষে কিছু একটা লেখার অস্তিত্ব টের পেল হাসান। ছোট বেলা থেকে গোপন মেসেজ আদান প্রদানের এই খেলাটা খেলে আসছে তারা দুজন! বোকা জেলার সেটা ধরতেই পারেনি। হো হো করে হেসে উঠল হাসান। চিঠিটা সেলের ভিতরে জ্বলতে থাকা বাল্বের দিকে উঁচু করে ধরল। আলোর বিপরীতে ধরতেই এবার চিঠির ভেতরে আরেক চিঠির সন্ধান পাওয়া গেল...

প্রিয় হাসান,

জীবনের প্রতিটি সংকটময় মুহূর্তে তুই আমার পাশে দাঁড়িয়েছিস। আজ আমারও উচিত তোর পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। কিন্তু আমি মনোবল হারিয়ে ফেলেছি। তার মানে কখনও ভেবে নিস না যে তুই আর আমি আলাদা কিছু।

আর কেউ না জানুক, আমি জানি তুই একজন জিনিয়াস। তোর পক্ষে কোন কাজই অসম্ভব নয়। জেলখানার চার দেয়াল তোকে আঁটকে রেখেছে- এই কথা আমাকে বিশ্বাস করতে বলিস? আমি জানি তুই ঠিকই নিজেকে মুক্ত করে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে নিতে পারবি।
আমি এখন কোথায় আছি জানিস? আমাদের সেই বাগানবাড়িতে! খুব একা লাগছে রে! তাড়াতাড়ি চলে আয় না! তোকে ছাড়া এভাবে একা কখনও থেকেছি বল? আর ভাল লাগছে না। জলদি চলে আয় বন্ধু! আমি তোর অপেক্ষায় বসে আছি!

আর একটা কথা! গতকাল রাতে একবার ব্ল্যাক আউট হয়েছিল আমার। তখন নতুন একটা ছবি এঁকেছি। দেখিস!

ইতি
তোর প্রাণের বন্ধু
মারুফ মুক্তাদির

চিঠি ফেলে খামটা হাতে নিলো হাসান। কোথায় ছবি? ভেতরে তো আর কোন কাগজ নেই! কিছুক্ষণ খামটা উল্টে পালটে দেখেই ব্যাপারটা ধরতে পারল সে। আসলে চিঠির খামটাই বানানো হয়েছে ছবি দিয়ে। আস্তে আস্তে আঠা ছাড়িয়ে খামটা পুরোপুরি মেলে ধরল হাসান। খামের ভেতর দিকে ছবিটা আঁকা ছিল বলে জেলারের চোখে পড়েনি! একজন মানুষ গলায় দড়ি বাঁধা অবস্থায় সিলিং থেকে ঝুলছে। আধ হাত জিভ বেরিয়ে এসেছে! চেহারারা চেনা চেনা লাগছে হাসানের। আরও ভাল করে লক্ষ করতে বুঝল মৃত লোকটা আসলে আশরাফ রবিন!

চোখ দুটো হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠল হাসানের। সেলের বাইরে উঁকি দিয়ে দেখল করিডোরের শেষ মাথায় দুই জন গার্ড দাঁড়িয়ে আছে! রাতের বেলা জেলে খুব একটা কড়া পাহারা থাকেনা। এই দুজনকে কাবু করতে পারলে জেল থেকে বেড়িয়ে যেতে খুব একটা বেগ পেতে হবেনা!

হঠাৎ পেট চেপে ধরে শুয়ে পড়ল হাসান। “আহ... উহ... মাগো... মরে গেলাম গো... পেটে কি ব্যথা...”

গার্ড দুজন হাসানের সেলের দিকে দৌড়ে আসার দুপ দাপ শব্দ শোনা যাচ্ছে!

(সমাপ্ত)

উৎসর্গঃ
আমার খুব কাছের দুজন মানুষ,
যারা এই গল্পের মতই বাস্তবেও খুব ভাল বন্ধু-
ইরেজার হাসান ও মারুফ মুক্তাদির খান
 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on January 30, 2015 18:19

January 27, 2015

দ্য পেইন্টার

"এক"

প্রচণ্ড এক আর্ত-চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে গেল হাসানের। ধড় মড় করে উঠে বসল। কি ঘটেছে বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে গেল। আওয়াজটা পাশের রুম থেকে এসেছে। নিশ্চয়ই মারুফ চিৎকার করেছে!

ঝট করে বিছানা ছেড়ে উঠল হাসান। তার বন্ধু মারুফের এই সমস্যাটা দীর্ঘদিনের। প্রায়ই রাতের বেলা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে ওঠে। কয়টা বাজে? বড়জোর ৬টা হবে। এত সকালে মারুফ কি দুঃস্বপ্ন দেখল?

দরজা খুলে পাশের রুমে উঁকি দিল হাসান। মারুফ তার বিছানায় বসে আছে। বুকের কাছে দুই হাঁটু ভাজ করে রাখা। তাকিয়ে আছে বেডের পাশে স্ট্যান্ডে দাঁড় করানো ছবি আকার ক্যানভাসের দিকে। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে কিছু একটা দেখছে।

হাসান বসল মারুফের গা ঘেঁষে। “কি হয়েছে রে? চিৎকার করছিস কেন? খারাপ কোন স্বপ্ন দেখেছিস?”

মারুফ মুখে কিছু বলল না। আঙ্গুল তুলে কিছু একটা দেখানোর চেষ্টা করল। হাসান সেদিকে তাকাল। ক্যানভাসে আটকানো মিডিয়াম সাইজের আর্ট পেপারে তুলির আচরে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে একটা জীবন্ত ছবি। হাসানের তুলি যেন কথা বলে! এত চমৎকার ছবি আঁকার ক্ষমতা খুব বেশি মানুষের থাকেনা! সে হয়ত বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ভাল পেইন্টারদের মধ্যে একজন হতে পারত। কিন্তু বিশেষ কারণে নিজের ছবি আঁকার এই প্রতিভা লুকিয়ে রেখেছে সবার কাছ থেকে।

“ছ... ছবিটা ভাল করে দেখ”!
হাসান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটা দেখল। নদীর জলে একটা মেয়ে চিত হয়ে ভাসছে! মুখ ও শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্ষতচিহ্ন। বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা মৃত। “একটা মেয়ের লাশ ভাসছে নদীতে! এখানে আর দেখার কি আছে?”
“তুই দেখতে পাচ্ছিস না হাসান! ভাল করে দেখ!” মারুফের কণ্ঠে তাগাদা দেওয়ার সুর।
আরও ভাল করে ছবিটা বোঝার চেষ্টা করল হাসান। আচমকা ব্যাপারটা নজরে পড়ল তার! মুখটা ক্ষতবিক্ষত হলেও ঠিকই চেনা যাচ্ছে! নদীর জলে লাশ হয়ে ভাসতে থাকা মেয়েটি আর কেউ নয়! শেফালী! তার বাগদত্তা।
“এ তুই কি ছবি এঁকেছিস মারুফ? কেন এঁকেছিস?”
“আ... আমি জানিনা... আমি কিচ্ছু জানিনা..." মারুফের কণ্ঠে আতংক। "সম্ভবত গতকাল রাতে ব্ল্যাক আউট হয়েছিল। তখন এঁকেছি। এই মাত্র ঘুম ভেঙে চোখে পড়ল”।

হাসানের দৃষ্টিতেও আতংক ফুটে উঠেছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে শেফালীর মৃত ছবি আঁকা দেখে এত ভয় পাওয়ার কি আছে? কিন্তু আর কেউ না জানুক, অন্তত হাসান জানে- মারুফ ভবিষ্যৎ আঁকতে পারে! তার আঁকা প্রত্যেকটা কাল্পনিক ছবির ঘটনা ভবিষ্যতে সত্য হয়!

"দুই"

“Operant conditioning is a method of learning that occurs through rewards and punishments for behavior. এর মানে হচ্ছে কোন আচরণের বিপরীতে পুরষ্কার বা শাস্তি দেয়ার ফলে আমার যে শিক্ষা গ্রহণ করি তাই হচ্ছে অপারেন্ট কন্ডিশনিং। উদাহারন স্বরূপ বলা যায়- একটা বাচ্চা শিক্ষকের শাস্তি এড়াতে হোমওয়ার্ক করে, আবার একজন কর্মচারী প্রমোশনের আশায় সুন্দরভাবে কাজ করে...”

কথা শেষ করতে পারল না ঢাবির সাইকোলজি বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ড. আশরাফ রবিন। এক ছাত্র হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে বসল, “স্যার, ক্লাসিক্যাল কন্ডিশনিংটা আরও একটু বুঝিয়ে দিলে ভাল হয়”।
মেজাজ খারাপ হল ড. রবিনের। তবুও শান্ত থাকার চেষ্টা করল। “এতক্ষণ যে জিজ্ঞেস করলাম সবাই বুঝেছ কিনা, তখন বলনি কেন?”
ছেলেটা আর কিছু বলছে না। পিছন দিক থেকে একটা মেয়ে বলে উঠল, “স্যার, ও ফ্রুট নিনজা খেলছিল”।

ক্লাসভর্তি সবাই হো হো হেসে উঠল। রবিনও না হেসে পারল না। কিন্তু মনের মধ্যে একটা বিরাট অসন্তুষ্টি কাজ করছে। এই যুগের ছেলে মেয়েরা অনেক বেশি বুদ্ধিমান। এদের বোঝার ক্ষমতা তাদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ কিন্তু বোঝার আগ্রহ অর্ধেকেরও কম!
ক্লাসিক্যাল কন্ডিশনিং এর আলোচনাটা আবার শুরু করতে যাবে এমন সময় মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠল। ডিপার্টমেন্ট এর চেয়ারম্যান বলে দিয়েছেন ক্লাসে শিক্ষকরা যেন মোবাইল সাইলেন্ট রাখে। কিন্তু রবিন প্রায়ই সেটা করতে ভুলে যায়।

পকেট থেকে বিরক্তচিত্তে মোবাইল বের করল সে। কলটা কেটে দিতে গিয়ে খেয়াল হল ফোন করেছে বন্ধু ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর ইকবাল খান। নিশ্চয়ই নতুন কোন কেস! আশরাফ রবিনের চোখে মুখে এক ধরনের ঔজ্জ্বল্য ধরা পড়ল। ছাত্র পড়ানোর মত একঘেয়েমি থেকে হয়ত একটু মুক্তি মিলবে এবার!

“আমার জরুরী একটা ফোন এসেছে। সবাই বই দেখে পড়াটা বুঝার চেষ্টা কর, আমি কথা বলে আসছি...” বলেই ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলো রবিন। পিছনে শুনতে পেল ইতিমধ্যে সব স্টুডেন্ট হই হুল্লোড় শুরু করেছে। হায়রে নেক্সট জেনারেশন, পড়াশোনায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই এদের!

রিসিভ করল সে, “হ্যালো, ইকবাল?”
“হ্যা, খুব বিজি সময় কাটছে নাকি রে?” ওপাশ থেকে প্রশ্ন করল ইকবাল।
“সেটা ডিপেন্ড করছে তুই কি ধরনের কাজের জন্য ফোন করেছিস তার উপরে। যদি আড্ডা দেয়ার উদ্দেশ্য থাকে তাহলে আমার হাতে একদম সময় নেই, কিন্তু যদি নতুন কোন কেসে হেল্প দরকার হয় তাহলে আই হ্যাভ অল দা টাইম অফ দা ওয়ার্ল্ড”।
“ঠিক কেস না। একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার ঘটেছে। একজন যুবক এসেছিল আমার কাছে, সে বলল তার বন্ধু নাকি ভবিষ্যতের ছবি আঁকতে পারে”!
“ওয়াও! ইন্টারেস্টিং তো”! রবিনের কণ্ঠে আগ্রহ প্রকাশ পেল।
তবে ওপাশ থেকে ইকবাল খানের কণ্ঠস্বর অনেক বেশি নিরুৎসাহী! “আমার মনে হচ্ছে সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার স্যাপার। এই ধরনের একটা বিষয় শুধু মুখের কথার ওপর বিশ্বাস করে কেস হিসেবে নেয়া পসিবল না। মনে হচ্ছে পুরোটাই গাঁজাখুরি। তবে তোর যদি আগ্রহ থাকে তাহলে আমি ছেলেটাকে তোর নম্বর দিয়ে দিতে পারি। তুই বোঝার চেষ্টা কর ব্যাপারটা আসলে কি”!
“দিয়ে দে, এমনিতেই বোরিং সময় কাটছে। লাইফে একটু উত্তেজনা দরকার”।

"তিন"

“আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনার বন্ধু মারুফ ভবিষ্যৎ দেখতে পায়?” চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার ফাঁকে জিজ্ঞেস করল রবিন। হাসানের সাথে বসেছে ডিপার্টমেন্টের টিচার্স লাউঞ্জের এক কোনায়।
“ঠিক তা নয়। মারুফ আসলে ভবিষ্যৎ আঁকতে পারে” হাসানকে যখন ইন্সপেক্টর ইকবাল বলেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজির একজন শিক্ষকের সাথে দেখা করে কথা বলার জন্য, সে ভেবেছিল হয়ত বয়স্ক কেউ হবেন! কিন্তু রবিনকে দেখে সে যার পর নাই অবাক হয়েছে। কত আর বয়স হবে? ত্রিশ? বত্রিশ? এই বয়সে পি এইচ ডি শেষ করে, নামের পাশে ডক্টর বসিয়ে, একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোফেসর হয়ে গেছে!
“কি ধরনের ভবিষ্যৎ?” আবার প্রশ্ন করল রবিন।
“ধরেন সে একজন সুস্থ মানুষের মৃত অবস্থার ছবি এঁকেছে, তাহলে লোকটা দুদিন পর আসলেও মরে যাবে”!
“আরও একটু খোলাসা করে বলা যায়?” আরেকবার কাপে চুমুক দিল রবিন।
“মানে... গোঁড়া থেকে শুরু করব?” হাসানের হাতের কাপে চা ঠাণ্ডা হচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই।
“হুম, তাহলে তো ভালই হয়”!
“ঘটনার শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে...

মারুফকে বলা চলে চাইল্ড জিনিয়াস। ৪ বছর বয়সেই তার ছবি আঁকার প্রতিভার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, কারো কাছে শেখেনি অথচ যে বয়সে বাচ্চারা কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং আঁকত, তখন মারুফ হুবহু মানুষের চেহারার স্কেচ আঁকতে পারত। আমরা প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামে বসবাস করতাম, তাই মারুফের এই প্রতিভার কথা খুব বেশিদূর এগোয়নি। কিন্তু আমরা তখনও জানতাম না মারুফের এই প্রতিভা আসলে অভিশপ্ত!

আমাদের বয়স যখন ৮ তখন সর্ব প্রথম এই অভিশাপের প্রমাণ মিলল। একবার কালবৈশাখী ঝড়ের সময় আমার ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা সবাই দল বেঁধে গ্রামের আমগাছ গুলোর নিচ থেকে আম কুড়িয়ে বস্তা বোঝাই করে ফেরার পথে জালাল দেখে ফেললো। জালাল আমাদের চেয়ে বয়সে দু তিন বছরের বড়, সে ছিল গ্রামের মেম্বারের ছেলে। বাবার ক্ষমতার জোরে সেও ক্ষমতা দেখিয়ে বেড়াত। আমাদের কাছ থেকে জালাল সবগুলো আম কেড়ে রাখল। সেদিন মারুফ অনেক কেঁদেছিল।

পরদিন স্কুলে মারুফ আমাকে একটা ছবি দেখাল। অংক খাতার পিছনের দিকে আঁকা। ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটা ছেলে বেকায়দা ভঙ্গিতে মাটিতে পড়ে আছে, বুঝা যাচ্ছে তার হাত পা ভাঙা। ছেলেটার মুখ দেখে বুঝলাম এটা জালাল। সেই ছবি সারা স্কুলময় ছড়িয়ে গেল। আমরা সবাই খুব হাসলাম। জালালের অপর বাচ্চারা প্রায়ই সবাই ক্ষেপে আছে, কিন্তু কারো পক্ষে তার টিকি ছোঁয়ার সাধ্য নেই। তাই সবাই মারুফের আঁকা ছবির মধ্যেই সান্ত্বনা খুঁজে পেলাম!

কিন্তু পর দিন একটা আমগাছের নিচে জালালকে হাতা পা ভাঙা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেল। আমরা সবাই তাজ্জব বনে গেলাম! মারুফের আঁকা ছবিতে জালালকে যেভাবে দেখেছি ঠিক সেই ভাবেই সে পড়ে আছে। বাচ্চাদের মধ্যে একটা আতংক সৃষ্টি হল। সবাই ভাবল মারুফের মধ্যে অদ্ভুত কোন ক্ষমতা আছে, সে যা আঁকে তাই সত্যি হয়ে যায়। বাচ্চারা মারুফের সাথে মেশা বন্ধ করে দিল। মারুফের কাছের মানুষ বলতে কেবল একজন রইল। সে হল আমি।

এর পরের ঘটনাটাতো আরও ভয়াবহ! একদিন আমি আর মারুফ গ্রামের বাজারে গিয়েছিলাম। বাজারে নরহরি কাকার মিষ্টির দোকান ছিল। নরহরি কাকার দোকানের মিষ্টি ছিল আমাদেরর অঞ্চলে বিখ্যাত। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসত মিষ্টি খাওয়ার জন্য। এমন অপূর্ব স্বাদ!

প্রায় সময়ই দুপুরবেলা দোকানে কাস্টমার থাকেনা। নরহরি কাকা এসময় চেয়ারে বসে ঝিমাতে থাকেন। গায়ের ছেলে মেয়েরা এই সুযোগে দোকানে ঢুকে গপাগপ গোটা দশেক মিষ্টি খেয়ে পালিয়ে যায়। সেদিন আমি আর মারুফ সুযোগটা কাজে লাগালাম। নিঃশব্দে দোকানে ঢুকে পড়ে চার পাঁচটা করে মিষ্টি পেটে চালান করে দিলাম। কিন্তু বিপত্তি ঘটাল মারুফ। তার হাত লেগে একটা মিষ্টির ডালা থেকে চামচ পড়ে গেল মাটিতে। শব্দ পেয়ে ঘুম ভেঙে গেল নরহরি কাকার। পালানোর সুযোগ পেলাম না আমরা, তিনি পাকড়াও করে ফেললেন দুজনকে। তারপর দোকানে বেঁধে রেখে আমাদের বাড়িতে খবর পাঠালেন।

বাড়িতে ফিরে দুজনেই বাবার হাতে বেদম পিটানি খেলাম। লজ্জায় বাইরে বে হওয়ার উপায় ছিলনা। গাঁ ভর্তি লোকজন সবাই দেখলেই চোর চোর বলে ক্ষ্যাপাত। ভীষণ রাগ হল নরহরি কাকার ওপর। ধরে যখন ফেলেছিলেন, দুই চারটা চড় থাপ্পড় দিয়ে ছেড়ে দিলেই তো পারতেন। বেঁধে রেখে বাড়িতে খবর পাঠিয়ে সারা গ্রামের লোকজনকে জানানোর কি দরকার ছিল?

একদিন মারুফ আমাকে তার হাতে আঁকা একটা ছবি দেখাল। ছবিটা দেখে আমি তো বমিই করে ফেললাম। ছবিতে দেখা যাচ্ছে নরহরি কাকার এক চোখের ওপর কাঁটা চামচ গাথা। চোখ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে গাল ভেসে যাচ্ছে। মারুফ কে নিষেধ করে দিলাম আর কখনও যেন এমন ছবি এঁকে আমাকে না দেখায়। এদিকে মনের মধ্যে একটা ভয় কাজ করছিল! আগের বার মারুফের আঁকা ছবিটি সত্য হয়েছিল। যদি এবারো হয়?

হলও তাই! একদিন পরই নরহরি কাকাকে ঐ অবস্থায় পাওয়া গেল। নরহরি কাকা অন্যান্য দিনের মত দুপুরবেলা দোকানে বসে ঝিমাচ্ছলেন, কে যেন সে সময় তার দোকানে ঢুকে পড়ে চোখে কাঁটা চামচ গেঁথে দিয়েছে! ওহ কি ভয়াবহ ব্যাপার! অবশ্য মারুফের দ্বিতীয়বার ছবি আঁকার এই বিষয়টা আমরা কাউকে জানালাম না, নিজেদের মধ্যে গোপন রাখলাম। এর পর এমন আরও অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে।

“বড় কারো সাথে এ বিষয়ে কখনও কথা বলেন নি?” কথা শুনতে শুনতে চা খাওয়া শেষ করেছে রবিন।
“না। আমরা দুজনে ভেবেছিলাম এটা হয়ত মারুফের এক ধরনের ক্ষমতা, সে ভবিষ্যৎ আঁকতে পারে। কিন্তু এরকম আরও কিছু ঘটনা ঘটার পর বুঝতে পারলাম আসলে ব্যাপারটা তা নয়। এটা ক্ষমতা নয়, এটা একটা অভিশাপ! মারুফ ভবিষ্যৎ আঁকতে পারেনা, মারুফ যা আঁকে তাই ভবিষ্যৎ হয়ে যায়”!
“এমনটা মনে হওয়ার কারণ?”
“কারণ মারুফ এখন পর্যন্ত কোন পজিটিভ ফিউচারের ছবি আকেনি” হঠাৎ খেয়াল হতেই হাতে ধরা চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিল মারুফ। মুখে বিস্বাদ লাগল, একদম ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। “হয় সে কোন দুর্ঘটনা, কারো মৃত্যু অথবা নৃশংস কোন ঘটনার ছবি আঁকে”।
“যখন বুঝতে পারল ব্যাপারটা আসলে অভিশাপ, তখন মারুফ কি করল?”
“মারুফ ছবি আঁকা ছেড়ে দিল” আরও একবার চুমুক দিতে গিয়েও দিলনা, কাঁপটা নামিয়ে রাখল হাসান। ঠাণ্ডা চা খাওয়া আর না খাওয়া একই কথা! “সে এখন শুধু মাঝে মধ্যে নিজের মনের আনন্দের জন্য ছবি আঁকে। কিন্তু ছবি গুলো কাউকে দেখায় না”।
“তাতে কি সমস্যা দূর হয়েছে?”
“না হয়নি। মাঝে মধ্যে অতি উত্তেজনায় মারুফের ব্ল্যাক আউট হয়। তখন সে অদ্ভুত আচরণ শুরু করে। কলম, পেন্সিল, রং, তুলি, কাগজ- যাই হাতের কাছে পায় তাই নিয়ে ছবি আঁকা শুরু করে! এবং এই ছবি গুলো ভবিষ্যতে সত্যি প্রমাণিত হয়! কিন্তু ব্ল্যাক আউটের পর্যায়টা পার করে এলে মারুফের আর কিছুই মনে থাকেনা। সে কখন এই ছবি এঁকেছে, কেন এঁকেছে- কিছুই বলতে পারেনা”!
“আপনারা এখন থাকেন কোথায়?”
“ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় দুজনের গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে এসেছিলাম। তারপর থেকে একসাথেই আছি দুজনে। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি। এখন ঢাকার মহাখালীতে একটা দুই রুমের ফ্ল্যাট নিয়েছি। আমি একটা সরকারি চাকরী করছি, মারুফ তেমন কিছু করেনা, মাঝে মধ্যে ফ্রি ল্যান্সর হিসেবে টুকটাক ডিজাইনের কাজ করে করে”।
রবিন পকেট থেকে রুমাল বের করল, চশমার কাঁচ গুলো একটু পরিষ্কার করা প্রয়োজন। “একসাথেই তো আছেন! কিন্তু আপনি কি কখনও মারুফকে ব্ল্যাক আউট অবস্থায় ছবি আঁকতে দেখেছেন?”
“না, দেখিনি!”
“এখন পর্যন্ত মারুফের যত গুলো আঁকা ছবি পরবর্তীতে সত্য হয়েছে তার একটাও কি আঁকার সময় আপনি দেখেছেন?”
এক মুহূর্ত চিন্তা করল হাসান। তারপর বলল, “ঠিক মনে করতে পারছি না আসলে... মারুফকে অনেকবার ছবি আঁকতে দেখেছি... কিন্তু তার আঁকা যে ছবিগুলো ভবিষ্যতে সত্যি হয়, তার একটাও আঁকার সময় সম্ভবত দেখিনি”!
রবিন তার চশমার কাচগুলো রুমাল দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করার ফাকে বলল, “এখন বলুন, এতদিন পর কেন বিষয়টা মানুষের কানে তুলছেন? এতদিন তো ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিলেন, আজ হঠাৎ পুলিশের শরণাপন্ন হওয়ার কারণ?”!
“কারণ?” এক মুহূর্ত সময় নিলো হাসান কারণটা বলতে। “কারণ আমি চাইনা মারুফ শেষ যে ছবিটি এঁকেছে তা সত্যি হোক”।
“কি আছে সেই ছবিতে?”
“আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি। আপনি চাইলে দেখতে পারেন”। বলে ডান কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের চেইন খুলল হাসান। একটা আর্ট পেপার বের করে বাড়িয়ে ধরল রবিনের দিকে।

রবিন ছবিটা হাতে নিয়ে চমকে উঠল! একটা মেয়ের ক্ষত বিক্ষত লাশের ছবি, পানিতে ভাসছে। এত্ত জীবন্ত ছবি, মনে হচ্ছে যেন প্রফেশনাল ক্যামেরা দিয়ে তোলা ছবিতে ইফেক্ট দেয়া হয়েছে! বলে না দিলে কেউ বিশ্বাস করবে না হাতে আঁকা! কি অসাধারণ এক প্রতিভা! এই ছেলের আঁকা ছবি যদি প্রচার পায় তাহলে নিঃসন্দেহে সে বিশ্বের সেরা চিত্রশিল্পীর আখ্যা পাবে! দেশের এই রকম একটা প্রতিভা লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে আছে কেন?

হাসান বলে চলেছে, “ছবিতে যে মেয়ের লাশ দেখছেন তার নাম শেফালী। মেয়েটি আমার হবু স্ত্রী, ইডেন কলেজে পড়ে”।
“আপনার বন্ধু মারুফ নিশ্চয়ই মেয়েটিকে চেনে?” প্রশ্ন করল রবিন।
“হ্যা, মেয়েটি সম্পর্কে মারুফের কাজিন হয়”।
একমুহূর্ত কিছু একটা চিন্তা করল রবিন। তারপর প্রশ্ন করল, “এখন পর্যন্ত এমন কোন ঘটনা ঘটেছে কি যেখানে মারফ যে ছবি এঁকেছে তাই ঘটেছে, কিন্তু মারুফের আঁকা ছবি দেখে যেভাবে ঘটবে বলে মনে হয়েছে ঠিক সেভাবে ঘটেনি?”
“হ্যা, হয়েছে”।
“একটু উদাহারন দিতে পারবেন?”
একটু ভেবে নিয়ে বলল হাসান, “আমার একটা পোষা কুকুর ছিল, খুব আদরের। একদিন মারুফ ছবি আকল কুকুরটার লাশ গলায় দড়ি বাঁধা অবস্থায় পানিতে ভাসছে। পরবর্তীতে গলায় দড়ি বাঁধা অবস্থায় কুকুরটির লাশ পাওয়া গেছে ঠিকই কিন্তু পানিতে নয়, পাওয়া গেছে পুকুর পাড়ে, একটা গাছের নিচে। এমন ঘটনা আরও দুই একবার ঘটেছে। কিন্তু আসল ব্যাপার হল সে যা আঁকবে তা সত্য হবেই। হুবহু মিলছে কিনা সে তো বড় বিষয় নয়”!
“বড় বিষয় নয় সত্যি, কিন্তু এক্কেবারে ফেলে দেওয়ার মত কথাও নয়”! বলল রবিন। “আপনার চা তো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আর এক কাপ দিতে বলব?”
“না থাক। এমনিতেই চা খেতে ইচ্ছে করছে না আর”।
“আপনি তাহলে আজ আসুন মিস্টার হাসান” একটু পরেই একটা ক্লাস নিতে হবে রবিনের, হাতে সময় নেই। “পুরো বিষয়টা নিয়ে আমি আজ রাতে একবার বসব, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করা লাগবে। আপনি বরং কাল ডিবি পুলিশের অফিসে আসুন , সেখানে ইন্সপেক্টর ইকবাল খানের সামনেই পুরো বিষয়টার একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করব। আপনার বন্ধু মারুফের সাথেও একটু দেখা করা প্রয়োজন, তবে ওনার সাথে কথা বলার আগে একটু পরিস্থিতিটা বুঝে নেয়া যাক”!
“যা করার তাড়াতাড়ি করুন স্যার। কারণ দেরি হয়ে যাচ্ছে”!
“হ্যা, আমরা যা করার করব” আশ্বাস দিল রবিন। “এই সময়টা আপনি একটু আপনার হবু স্ত্রীর দিকে খেয়াল রাখুন।

"চার "

“তোর কথা গুলো আষাঢ়ে গল্পের মত শোনাচ্ছে রবিন” ইন্সপেক্টর ইকবাল খানের কণ্ঠে নির্ভেজাল বিস্ময়।

ইকবাল খান আর রবিন স্কুল বন্ধু। দুজনে পড়েছেও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে। একজন বিসিএস পরীক্ষায় ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করে হয়েছিল সাব ইন্সপেক্টর। পরবর্তীতে ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তার কারনে প্রোমোশন পেয়ে চলে এসেছে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চে। অন্যজন কানাডা থেকে পিএইচডি করে এসে হয়েছে নিজের ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক। তবে দুজনের মধ্যে একটা বিষয়ে প্রচুর মিল লক্ষ করা যায়! দুজনেরই সবচেয়ে পছন্দের কাজ হচ্ছে ক্রাইম সলভ করা।

“আমি ঠিকই বলছি” রবিনের বলার ধরনে কোন হেঁয়ালি নেই। অর্থাৎ যা বলছে তা বিশ্বাস করে। “মারুফের আঁকা ছবিগুলো ভবিষ্যতে সত্য প্রমাণিত হওয়ার বিষয়টি আসলে কোন অলৌকিক ঘটনা নয়। মারুফ নিজেই এর জন্য দায়ী”।
“এখানে মারুফ কীভাবে দায়ী হয়?” ইকবাল খানের বিস্ময় কাটছে না। দুজনে বসে আছে ইকবাল খানের অফিসে। হাসানেরও আসার কথা ছিল কিন্তু এখনও এসে পৌঁছায়নি। “একটু ঝেড়ে কাশ না প্লিজ”!
“সব বুঝিয়ে বলছি, তার আগে বলি কীভাবে বুঝলাম ব্যাপারটা যে অলৌকিক নয়”!
ইকবাল খান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
রবিন বলছে, “মারুফ যে ঘটনার দৃশ্য আঁকে তা সব সময় হুবহু মিলে যায় না। হাসানের মুখ থেকেই শুনেছি বেশ কয়েকবার এর ব্যতিক্রম হয়েছে। এটা যদি কোন অলৌকিক ক্ষমতা হত তাহলে প্রত্যেকবার হুবহু মিলে যাওয়ার কথা! ব্যতিক্রম যেহেতু হচ্ছে তাহলে ব্যাপারটিকে আর অলৌকিক ক্যাটাগরিতে ফেলা যাচ্ছেনা। দুই একটা ঘটনা সত্য হলে ব্যাপারটিকে কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেয়া যেত। কিন্তু মারুফ যা আঁকে তা প্রত্যেকবারই ঘটে। হুবহু না হোক, ছবির ঘটনা সত্যি হয়। তারমানে কি দাঁড়াচ্ছে? পুরো ব্যাপারটা আসলে প্রি-প্ল্যানড”।
“তুই বলতে চাচ্ছিস মারুফ প্রথমে ছবি আঁকে তারপর সেই ছবির ঘটনা সত্যি করার জন্য কাউকে পাঠায়?” ইকবাল খানের প্রশ্ন।
“কাউকে পাঠায় না। সে নিজেই কাজগুলো করে”।
“তুই কীভাবে এতটা শিওর হচ্ছিস?”
“এখন পর্যন্ত হাসান মারুফকে কখনও ছবি আঁকতে দেখেনি। এমনকি ছবির ঘটনা সত্য হওয়ার সময়টাতেই সে কখনও উপস্থিত থাকেনা। অর্থাৎ মারুফ একটি ছবি আঁকে, সেটা হাসানকে দেখায়, তারপর হাসানের অলক্ষ্যে গিয়ে কাজটি করে আসে”।
“কিন্তু এতে লাভ কি বল?”
“আমার মনে হয় মারফ কোন লাভ লোকসানের হিসেব করেনা। অদ্ভুত কোন মানসিক রোগ আছে তার। কিছু মানুষের সামনে নিজেকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে দেখিয়ে তৃপ্তি পাচ্ছে সে”।
“তাহলে শেষ ছবিটার ব্যাখ্যা কি ?” ইকবাল খান রবিনের থিওরিটা পুরোপুরি মেনে নিতে পারছে না। “মারুফ নিশ্চয়ই তার বন্ধুর হবু স্ত্রীকে পাশবিক নির্যাতন করে মেরে ফেলতে চাইবে না! তার উপর মেয়েটি সম্পর্কে মারুফের কাজিন হয়”!
রবিন হাসল, বলল, “বন্ধু আমরা এখানে সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডারে ভুগছে এমন পেসেন্টের কথা বলছি। এরা কখনও কাজের ফলাফল নিয়ে চিন্তিত নয়! তুই আমি যেমন যেকোনো বিষয় নিয়ে স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করতে পারি ওরা সেটা করেনা। হয়ত মারুফ কোন ডুয়েল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারে ভুগছে। সচেতন মন যে ছবি আঁকে, অবচেতন মনে সে কাজটি করে আসে। কিন্তু সচেতন মনে সেই খবর পৌঁছায় না! এখন মারুফের সাথে কথা বলতেই আমি নিশ্চিত হতে পারব তার সমস্যা কি!”

আরও কিছু হয়ত বলত রবিন কিন্তু হঠাৎ ইকবাল খানের ফোন বেজে ওঠায় কথার রেশ টানতে হল তাকে। ফোন করেছে হাসান। ইকবাল রিসিভ করল, হ্যা”লো! ডিবি ইন্সপেক্টর ইকবাল বলছি”।
“স্যার, আমি হাসান বলছি” হাসানের কণ্ঠে প্রচণ্ড অস্থিরতা টের পাচ্ছে ইকবাল।
“হ্যা, মিস্টার হাসান। আপনার না আজ আসার কথা ছিল?”
“স্যার, আমি আসছিলাম। পথে খবর পেলাম আমার বাগদত্তা স্ত্রী শেফালী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে। তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে”।
“বলেন কি?” আঁতকে উঠল ইকবাল।
“জি স্যার। হাসপাতালে এসে জানতে পারলাম মারুফ শেফালীকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির নিচে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। পুলিশ মারুফকে গ্রেফতার করেছে”।

ফোন কেটে দিয়ে কয়েক মুহূর্ত হতবাক চোখে তাকিয়ে রইল ইকবাল। তারপর রবিনকে উদ্দেশ্য করে বলল, “বন্ধু, তোর কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে...”

"পাঁচ"

অন্ধকার একটা কক্ষ। জানালা বা ভেন্টিলেটর নেই যে একটু আলো চুইয়ে এসে ভেতরে ঢুকবে। এক মাত্র দরজাটিও বন্ধ। কক্ষের ভেতর আসবাব বলতে একটি ছোট টেবিল ও চেয়ার। চেয়ারের ওপরে বসিয়ে রাখা হয়েছে একজন আসামীকে। তার দু হাত চেয়ারের সাথে হ্যান্ড কাফ দিয়ে আটকানো। সামনে ছোট্ট একটি সাদার রঙের টেবিল। মাথার একটু ওপরে ১০০ পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। বাল্বের চারদিকে প্লাস্টিকের শেড লাগানো থাকায় আসামির মুখের কাছে অংশটুকু আলোকিত হয়ে থাকলেও সমস্ত ঘর অন্ধকার। তাছাড়া সিলিং ফ্যান না থাকায় কক্ষের ভেতর এক ধরনের ভ্যাঁপসা গরম অনুভূত হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রচণ্ড রকমের অস্বস্তিকর এক পরিবেশ।

মারুফ ভেবেছিল এমন ইন্টারগেশন কক্ষের অস্তিত্ব শুধু নাটক সিনেমাতেই দেখা যায়। বাস্তবে এমনটা হওয়া সম্ভব নয়, অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তো অবশ্যই নয়। কিন্তু আজ তার ধারনাটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আসামির চেয়ারে বসে আছে সে নিজেই। ইন্টারোগেশন করছে ইন্সপেক্টর ইকবাল খান।

চোখের সামনে সারাক্ষণ আলো ধরে রাখার ফলে মারুফের চোখে জ্বালা ধরে গেছে। সামনে টেবিলটা ছাড়া রুমের এতরে আর কিছুই নজরে আসছে না তার। ফলে ইন্সপেক্টর ইকবাল খানের প্রশ্নগুলো মনে হচ্ছে যেন অদৃশ্য কেউ করছে!

“মারুফ, যা বলছি তার জবাব দিন” ইন্সপেক্টর ইকবাল খানের কণ্ঠ। “বলুন কেন কাজটি করেছেন?”
“আমি অনেকবারই এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। কিন্তু আপনারা বিশ্বাস করেন নি” থমথমে গলায় বলল মারুফ।
“আমরা সত্যিটা জানতে চাচ্ছি”।
“যা বলছি এটাই সত্যি। আমি চেয়েছিলাম শেফালীর মৃত্যুটা সহজ হোক। অনেক কঠিন মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে তার জন্য”।
“আপনার কেন এমন মনে হচ্ছে?”
“কারণ আমি তার ক্ষত বিক্ষত লাশের ছবি এঁকেছি। কেউ একজন তাকে প্রচণ্ড নির্যাতন করে মেরে লাশটা পানিতে ফেলে দিয়েছে। আমার আঁকা ছবি কখনও ভুল হয়না। আজ পর্যন্ত হয়নি, ভবিষ্যতেও হবেনা”।
“কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে ভেতরে অন্য কোন ব্যাপার আছে”! কৌতুকপূর্ণ কণ্ঠে বলল ইকবাল খান। “এমন কি হতে পারেনা যে আপনি যার অনিষ্ট কামনা করেন, তাকে নিয়ে আজগুবি সব ছবি আঁকেন, তারপর সেই ছবির ঘটনাকে বাস্তবে রূপ দিতে জঘন্য সব কাজ করে বেড়ান”!
“কি বুঝাতে চাচ্ছেন আপনি?”
“আপনি যেখানে শেফালীকে গাড়ির নিচে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন। সেখান থেকে খুব কাছেই একটা জলাশয় আছে। দুর্ঘটনার পর শেফালীকে নিয়ে পানিতে ফেলে দিলে আপনার ছবির ঘটনা কিন্তু সত্যি হয়ে যেত”!
“কক্ষনো না”! দৃঢ় কণ্ঠে বলল মারুফ। “আমি শেফালীর সাথে এমন কাজ করতেই পারিনা”।
“কেন পারেন না?”
“কারণ... কারণ...” কিছুক্ষণ আমরা আমতা করে চুপ হয়ে গেল মারুফ।
“কারণটা আমি বলছি মিস্টার মারুফ”! নাটুকে ভঙ্গিতে এক মুহূর্ত থেমে থাকল ইকবাল খান। তারপর বলল, “কারণ আপনি আপনার খালাত বোন শেফালীকে পছন্দ করতেন। আপনার বন্ধু হাসানের সাথে তার বিয়ের বিষয়টি আপনি মেনে নিতে পারেন নি। এদিকে হাসান বিশ্বাস করে আপনি ভবিষ্যৎ আঁকতে পারেন। সেই সুযোগই আপনি নিতে চেয়েছিলেন”।
“আমি যদি শেফালীকে পছন্দ করি তাহলে তাকে মারতে চাইব কেন?”
“ভালবাসা শুধু গড়তে জানেনা মারুফ! ধ্বংস করতেও জানে”!
“আপনারা মারাত্মক ভুল করছেন ডিটেকটিভ...”
“আমরা ভুল করছি কিনা সে হিসাব করার জন্য আপনাকে এখানে আনা হয়নি” বলল ইকবাল খান। “আমি শুধু জানতে চাই আপনি শেফালীকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির নিচে ফেলে মারতে চেয়েছিলেন কিনা”!
কয়েক মুহূর্ত নীরবতা। মারুফ সংক্ষেপে বলল, “হ্যা”।
“ব্যাস। আর কিছু জানার নেই আমার” বলল ইকবাল খান। “আপনাকে দেখে আমার লজ্জা হচ্ছে মিস্টার মারুফ! ছবি আঁকার কি অসাধারণ প্রতিভা আপনার মাঝে। সেটা এভাবে অপব্যবহার করে চলেছেন?”
“আপনারা ভুল করছেন”! হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠল মারুফ। “ছবিগুলো আমি সচেতন ভাবে আঁকি না। মাঝে মধ্যে আমার ব্ল্যাক আউট হয়, তখন কি ছবি আঁকি তা পরবর্তীতে মনে থাকেনা...”
মারুফের কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে না ইকবাল খান। দরজা খুলে বেরিয়ে আসছে তখন পিছন থেকে মারুফ প্রায় চিৎকার করে বলল, “শেফালীকে বাঁচান প্লিজ! অনেক বড় বিপদ অপেক্ষা করে আছে তার জন্য”।
“শেফালী এখন বিপদমুক্ত, কারণ আপনি আটক আছেন আমাদের হাতে” বলেই বেরিয়ে এলো ইকবাল।

ইন্টারোগেশন রুমের ঠিক বাইরেই অপেক্ষা করছিল রবিন। ইন্টারকমে ভেতরের সব কথপকথন শুনেছে সে। ইকবাল বেরিয়ে আসতেই বলল, “কি সিদ্ধান্ত নিলি?”
“এটেম্পট টু মার্ডারের কেস করে দিব” ইকবাল খানের চোয়াল দুটি শক্ত হয়ে আছে। “রিপোর্টে ঠাণ্ডা মাথার একজন সাইকো হিসেবে দেখাব মারুফ মুক্তাদির কে”।
“কিন্তু সত্যি যদি সে অবচেতন মনে কাজগুলো করে থাকে? সত্যি যদি তার মধ্যে কোন ডুয়েল পারসোনালিটি সংক্রান্ত সমস্যা থেকে থাকে? তাহলে তো তার যায়গা জেলখানা নয়, মানসিক হাসপাতাল”!
“তুই কি হলিউডের ফিল্মের জগতে বসবাস করিস?” ইকবাল খানকে দেখে মনে হল রেগে যাচ্ছে! “এইটা বাংলাদেশ। এইসব ডুয়েল পারসোনালিটির মামলা এখানে শুধু গল্পেই সম্ভব। একজন বিকৃত চিন্তা ভাবনার আসামীর মানসিক চিকিৎসা করাটা আমাদের জন্য বিলাসিতা! মারুফের অপরাধের বিচার প্রচলিত নিয়মেই হবে, কোন স্পেশাল কন্সেনট্রেশন দেয়া যাবেনা। কেস ক্লোজড!”

(আগামী পর্বে সমাপ্য)
 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on January 27, 2015 11:19

October 5, 2014

স্বপ্নবৃত্ত (ফিরে আসা অথবা না ফেরার গল্প)

একজন মধ্যবয়সী পুরুষকে কপালে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় প্লেনে উঠতে দেখলে অন্যান্য যাত্রীরা কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। আমি উঠেছি কুয়ালালামপুর থেকে ঢাকাগামী একটা যাত্রীবাহী প্লেনে। কপালে মোটা করে ব্যান্ডেজ বাঁধা, চলা ফেরায় একটু আড়ষ্ট ভাব।

ইন্টারকমে ফ্লাইট ক্যাপ্টেন ঘোষণা দিলেন প্লেন ছাড়তে আর খুব বেশি সময় বাকি নেই। সবাই যেন নিজেদের সিট-বেল্ট বেঁধে নেয়।

আমার সিট-বেল্ট বাঁধতে একটু ঝামেলা হচ্ছে। ডান হাতে ব্যথা পাওয়ার দরুন কাজটা করতে হচ্ছে বা হাতে। হাতে খুব একটা জোর পাচ্ছিনা। একবারে নয়, দুইবারেও নয়, তিনবারের চেষ্টায় আমি সিট-বেল্টটা আটকাতে সমর্থ হলাম।

“আর ইউ অলরাইট?”

প্রশ্নটা শুনে পাশের সিটে তাকালাম। আমার পাশে একজন বৃদ্ধা বসেছেন। দেখে মনে হচ্ছে ইউরোপিয়ান।

“হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি”। পরিষ্কার উচ্চারণে জবাব দিলাম আমি।

মহিলাকে দেখে মনে হচ্ছে একটু অবাক হয়েছেন। একজন এশিয়ানের মুখে হয়ত তিনি এত চমৎকার ইংরেজি আশা করেন নি।

“আমি ভাবলাম তোমার কোন সাহায্য দরকার কিনা”! বৃদ্ধা অমায়িক ভঙ্গিতে হাসলেন।

“না না, সব ঠিক আছে”! আমিও সুন্দর করে হাসার চেষ্টা করলাম।
“কপালের ব্যান্ডেজ দেখে মনে হচ্ছে ভালই আঘাত পেয়েছ”!

আমি একহাতে কপালের ব্যান্ডেজটা স্পর্শ করলাম। ভুলেই গিয়েছিলাম সেটার অস্তিত্বের কথা! বৃদ্ধার উদ্দেশ্যে বললাম, “ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলাম, পেটালিং জায়ায়, সানওয়ে পিরামিড হোটেলের সামনে”।

“বল কি?” মহিলাকে বিচলিত মনে হল। “কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার! ওরা তোমার কাছ থেকে কিছু নিতে পেরেছে?”

প্রশ্নটা শুনে কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করলাম আমি। ঠোঁটের কোনে একটা তিক্ত হাসি ফুটে উঠল। মনে মনে বললাম, “নিয়েছে! অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস তারা নিয়ে গেছে”! মুখে বললাম, “হ্যাঁ, আমার ওয়ালেটটা ছিনতাই করেছে”।

“থাক! খুব বেশি ক্ষতি তাহলে হয়নি”। মহিলা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল যেন। অথচ আমার কত বড় ক্ষতি হয়েছে সেটা ওনার ধারনার বাইরে! মহিলা পরিচিত হওয়ার জন্য হাত বাড়াল, “আমি প্যাট্রিসিয়া গোমেজ”।

আমি হাসিমুখে হাত মেলালাম, “আমি আব্দুর রশিদ”।

“তোমার সাথে পরিচিত হতে পেরে ভাল লাগছে রশিদ। তুমি কি বাংলাদেশি?”

“রশিদ” শব্দটা সঠিক উচ্চারণে বলতে পারলেও “বাংলাদেশি” শব্দটার উচ্চারণ শুদ্ধ হলনা। অনেকটা “ব্যাংলাদ্যাশি” শোনাল। আমি বললাম, “হ্যাঁ, আমি বাংলাদেশি। একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোফেসর। আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগদানের উদ্দেশ্যে মালয়েশিয়া এসেছিলাম”।

“জিসাস! আমার পাশে একজন প্রোফেসর বসে আছেন! কি সৌভাগ্য আমার”! মহিলার কণ্ঠে অকৃত্রিম আনন্দের সুর।

আমি হাসি ধরে রেখেছি। “আপনি কেন যাচ্ছেন বাংলাদেশে?”

“আমি ডেনমার্কের নাগরিক। আমার স্বামী ভিনসেন্ট গোমেজ তোমাদের দেশে একটা ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্টে কাজ করছে”। মহিলা এমন ভঙ্গিতে কথাটা বলল যেন বাংলাদেশে কাজ কতে পারাটা বিরাট বড় গর্বের বিষয়। “আমি তার সাথে দেখা করতেই বাংলাদেশ যাচ্ছি। ডেনমার্ক থেকে তো সরাসরি বাংলাদেশে যাওয়া যায়না, মালয়েশিয়া পর্যন্ত এসে বিমান পরিবর্তন করতে হয়”।

“জেনে ভাল লাগল”। আমি হাসিমুখে বললাম।

ভাল করে দেখছি বৃদ্ধাকে। কত বয়স হবে ওনার? ষাটের উপরে নিশ্চয়ই! এই বয়সেও যথেষ্ট শক্ত-সামর্থ্য আছেন। আমাদের দেশে এই বয়সী বেশিরভাগ নারী অন্যের সাহায্য ছাড়া চলতে পারে না। আর উনি একা একা ভিনদেশে চলে এসেছেন স্বামীর সাথে দেখা করার জন্য।

ইন্টারকমে আবারো ক্যাপ্টেনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। প্লেন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই টেইক অফ করবে। সবাইকে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে বলা হল। এয়ার হোস্টেজরা শেষ বারের মত পরীক্ষা করে দেখছে সবার সিট-বেল্ট ঠিকমত বাঁধা হয়েছে কিনা!

প্লেনটা রানওয়ে ধরে ছোটা শুরু করল। একটু একটু করে গতি বাড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি টের পেলাম প্লেনের চাকাগুলো মাটি ছেড়ে শূন্যে উঠে পড়ল। বাতাসে ভর দিয়ে ভাসছে। দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বিমান। পেছনে ফেলে যাচ্ছি ব্যস্ত শহরের কোলাহল, সানওয়ে পিরামিড হোটেল আর এমন একটি ঘটনা যা আমার জীবনটাকে রাস্তার মাঝখানে এনে ছেড়ে দিয়েছে।

“অনেক টাকা ছিল তাইনা?”

আমি একটু অন্যমনস্ক ছিলাম। মিসেস গোমেজের প্রশ্নটা শুনে সংবিৎ ফিরে পেলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “আমাকে কিছু বলছেন?”

“তোমাকে একটু আপসেট দেখাচ্ছে। তাই জিজ্ঞেস করলাম ছিনতাই হওয়া ওয়ালেটে অনেক টাঁক ছিল কিনা”! মিসেস গোমেজ বললেন।

“আ.. আমি ঠিক জানিনা”। কি জবাব দিব বুঝতে পারছি না। আমার মনে পড়ল হাসপাতালের বিছানায় জ্ঞান ফিরার পর আমি কেমন হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম। আমি কে? কোথায় থাকি? কোত্থেকে এসেছি- কিছুই মনে পড়ছিল না। “খুব বেশি টাকা থাকার কথা না। আসলে ওরা মাথায় আঘাত করার পর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। এর পর সব কিছু ঠিকমত মনে করতে পারছি না। বলতে পারেন একটু মেমোরি লসের প্রবলেম দেখা দিয়েছে”।

মহিলার মুখ থেকে আফসোস করার মত এক ধরনের শব্দ বেরিয়ে এলো। বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা লোক দেখানো নয়। আসলেও ব্যথিত হয়েছেন ঘটনাটা শুনে। “আহারে! কিন্তু এরপর তোমার স্মৃতিগুলো ফিরে এসেছে নিশ্চয়ই”?

“হ্যাঁ, কিছু স্মৃতি ফিরে এসেছে। পুলিশ আমার ওয়ালেট আর মোবাইলটা উদ্ধার করে এনেছে। মোবাইলের কন্টাক্ট লিস্ট, মেসেজ সহ সব কিছু গায়েব। কিন্তু ওয়ালেটের মধ্যে আমার বাংলাদেশি ড্রাইভিং লাইসেন্স আর ভিজিটিং কার্ড ছিল। নিজের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর সব মনে পড়েছে আমার”।

“আর কোন স্মৃতি মনে পড়েনি?” মহিলা উদ্বিগ্ন যেন আমার স্মৃতি ফিরে না আসাটা তারই দোষ!

আমি বললাম, “হ্যাঁ, এই ঘটনার পরও কনফারেন্সের কাজে কিছুদিন থাকা লেগেছে মালয়েশিয়ায়। বিভিন্ন সময়ে একটু একটু করে টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো ফিরে এসেছে”।

“আর কি কি মনে পড়ল?”

“আমি বিবাহিত। আমার স্ত্রীর নাম স্বর্ণা, পুরোদস্তুর বাঙালী গৃহিণী। আমার দুটি সন্তান আছে। ছেলেটার নাম জিতু, হাই স্কুলে পড়ে। মেয়েটার নাম মিতু, ও পড়ে কলেজে। আমরা ছোট্ট সুন্দর একটা ফ্ল্যাটে বসবাস করি। এইতো, খুব সাধারণ জীবন আমার”!

“বাহ! একটা পারফেক্ট ছোট্ট সুখী পরিবার”। মিসেস গোমেজ আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসলেন।

আমি ভাবছি কেন আমি এই মহিলার কাছে এসব কথা বলছি? মহিলা খুব আন্তরিক, মায়ের বয়সী, আমার প্রতি মায়া দেখাচ্ছেন- কিন্তু এগুলো কোন যুক্তিযুক্ত কারণ হতে পারেনা! যে কথাগুলো নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বলিনি তা এই মহিলাকে কেন বলতে যাব? আসলে আমি সম্ভবত কাউকে খুজছিলাম যার সাথে এই কথা গুলো বলে একটু হালকা হওয়া যায়। এমন কেউ যে আমাকে চেনেনা, যাকে কথাগুলো বলার মাঝে কোন ক্ষতি নেই। আমার ফিরে আসা স্মৃতির মাঝে এমন কিছু বিষয় আছে যা পরিচিত কাউকে বলা সম্ভব নয়!

বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচে একটা আন্তর্জাতিক কর্মশালায় যোগদানের জন্য চারদিনের সফরে মালয়েশিয়া এসেছিলাম আমি। ছিনতাইয়ের ঘটনাটা ঘটেছে সানওয়ে হোটেলে ওঠার ঠিক পাঁচ ঘণ্টা পর। মাথায় আঘাত পাওয়ার পর আমাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। জ্ঞান ফেরার পর আমি কে? কোত্থেকে এসেছি? কিছুই মনে করতে পারছিলাম না!

পুলিশ আমার ওয়ালেট আর মোবাইলটা উদ্ধার করতে পেরেছিল। ওয়ালেট থেকে পাওয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স আর ভিজিটিং কার্ড দেখে নিজের পরিচিত খুঁজে পেলাম। মালয়েশিয়ায় এসেছি কি উদ্দেশ্যে তাও মনে পড়ল। কিন্তু নিজের পরিবার-পরিজন সম্পর্কে কিছুই মনে পড়েনি। হাসপাতাল থেকে ফিরে মাত্র ৬ ঘণ্টার বিশ্রাম নিয়েই আবার কনফারেন্সে যোগ দিলাম। এর পর নানা টুকরো টুকরো ঘটনার মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে মনে পড়ছিল সব কিছু।

প্রথমেই মনে পড়ল আমার স্ত্রী স্বর্ণার কথা। তার সাথে প্রথম দেখা হওয়ার সেই স্মৃতি কখনও ভুলে যাওয়ার নয়। কোন এক পহেলা বৈশাখে লাল শাড়ি পরিহিতা মেয়েটি শাহবাগের মোড়ে একা একা দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। ভিড়ের মধ্যে কে যেন তার পার্সটা চুরি করেছে। বান্ধবীদের কাছ থেকেও দলছুট হয়ে পড়েছে। চিটাগাং থেকে ঢাকায় বেড়াতে এসেছে কদিন হল, রাস্তা-ঘাট কিছুই চেনেনা।

আমি এগিয়ে গিয়েছিলাম তাকে সাহায্য করার জন্য। সারাটা বিকেল ধানমণ্ডি-কলাবাগান এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজে অবশেষে রাত ১১টার দিকে তাকে ঠিকানামত পৌঁছে দিতে পারলাম। অবশ্য এর মধ্যে স্বর্ণার পাশাপাশি কাটানো কয়েকটি ঘণ্টা ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলোর মাঝে একটি। দুজনে ধরা পড়লাম প্রগাঢ় প্রেমের বন্ধনে।
এর পরের যে স্মৃতি আমার মনে পড়ছে সেখানে স্বর্ণা আমার স্ত্রী। আমি খুব ক্লান্ত হয়ে কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরেছি। স্বর্ণা এগিয়ে এসে আমার গা থেকে কোর্ট টা খুলে রাখল। টাইয়ের নট খুলে দিচ্ছে, পা থেকে জুতো খুলতে সাহায্য করছে। রাতে বাচ্চাদেরকে সাথে নিয়ে আমরা ডিনার করছি। ডিনার শেষে সবাই একসাথে বসে টিভিতে একটা ফ্যামিলি ড্রামা দেখছি। আরও কত কি...

তাহলে এখন তো সব ঠিক ঠাক ? মিসেস গোমেজ প্রশ্ন করলেন।

আমি সঙ্গে সঙ্গে মহিলার প্রশ্নের জবাব দিলাম না। পকেট থেকে রুমাল বের চশমার কাঁচ মুছলাম। বুঝতে পারছি না সমস্যাটা তার কাছ খুলে বলা উচিত হবে কিনা! বললাম, “মনে তো হচ্ছে সব ঠিকই আছে”।
নাহ! মহিলা মাথা নাড়লেন। আমার মনে হচ্ছে এখানে কোথাও একটা কিন্তু আছে যা তুমি আমার কাছে বলতে চাইছ না! অবশ্য তোমার আপত্তি থাকলে জোর করে বলার দরকার নেই।

আমি ভেবে দেখলাম। মহিলাকে বললে আসলে কোন ক্ষতি নেই। উনি আমাকে চেনেন না, জানেন না। কথাগুলো গোপনই থাকবে। আর আমারও মনে হচ্ছে কারো সাথে কথা গুলো শেয়ার করলে হয়ত সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে!

বললাম- “সব কিছুই ঠিক আছে। শুধু একটা জিনিস বাদে”!

কি সেটা? আগ্রহে মহিলার চোখ দুটি চকচক করে উঠল।

“জেনি”! আমি সংক্ষেপে জবাব দিলাম।

"জেনি? কে জেনি?"

আমার মুখে তিক্ত হাসি। আমার স্মৃতি ফিরে এসেছে ঠিকই, কিন্তু সাথে নিয়ে এসেছে ভয়ংকর এক উপাদান। শিক্ষকের সাধারণ জীবন, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ছাড়াও আমার জীবনে সম্ভবত আরও একজন আছে। বেশ লম্বা, আগুন-সুন্দরী আর কামোত্তেজক দৈহিক গড়নের অধিকারী একজন নারী! জেনি!

স্ত্রী স্বর্ণার কাছে প্রায়ই ফ্যাকাল্টি মিটিং আছে, অন্য বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে যাব, শহরের বাইরে বিশেষ ভাইভা এক্সামে এক্সটারনাল হিসেবে ডিউটি পড়েছে- এ ধরনের মিথ্যা বলে আমি গোপনে জেনির সাথে মিলিত হই। আমাদের বুনো জানোয়ারের মত জৈবিক চাহিদা পূরণের উদ্দাম খেলা চলে গভীর রাত অবধি!

কিন্তু আমি অনেক ভেবে দেখেছি। আমার শান্ত-ভদ্র-নিরুপদ্রব জীবনে কোথায় জেনি খাপ খাচ্ছেনা। সম্ভবত জেনি বাস্তব কোন চরিত্র নয়। আমার মনের ভেতর বাস করা এক ধনের ফ্যান্টাসি। যা কিছু আমি স্বর্ণার কাছ থেকে পাইনি তাই হয়ত পূরণ করে নিয়েছি জেনি নামের এই কাল্পনিক চরিত্রটিকে আপন করে নিয়ে!

আমি মিসেস গোমেজকে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম। বৃদ্ধা চোখগুলো সরু করে খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনলেন। সব বলা শেষে দেখলাম মহিলা চুপ করে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এমন ফ্যান্টাসির কথা শুনে নিশ্চয়ই খুব হাসি পাচ্ছে আপনার?”

“একদম না”! মিসেস গমেজ তাৎক্ষনিক জবাব দিলেন। “পৃথিবীতে কেউ পারফেক্ট হয় না! আমি একজন পুরুষের সাথে জীবনের ৩০টি বছর পার করেছি। এমন অনেক স্বপ্নই অধরা রয়ে গেছে যা আমার স্বামী পূরণ করতে পারেনি! ফ্যান্টাসির মাঝে ডুবে থেকে স্বপ্নের সেই সব শূন্যস্থান আমি নিজেই পূরণ করে নিয়েছি। তাই তোমার ঐ ধরনের ফ্যান্টাসি থাকাটা হাস্যকর কিছু নয়। অবশ্য সত্যিই যদি বিষয়টা তোমার ফ্যান্টাসি হয়”!

“সমস্যাটা আসলে এখানেই”। আমি বললাম।

প্রথমবার জেনির স্মৃতি মনে আসার সময়টুকু আমার আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। কনফারেন্সে একটা বোরিং দিন কাটিয়ে এসে আমি হোটেলে ফিরেছি। নিজের রুমে ঢুকে কোর্ট টাই না খুলেই বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। খুব টায়ার্ড লাগছে, মাথাটাও কেমন যেন ঝিম ঝিম করছে। ঠিক তখনই জেনির কথা মনে পড়ল আমার!

আমি আর জেনি খুব ঘনিষ্ঠ অবস্থায় রয়েছি। মুহূর্তগুলো বড় বেশি বাস্তব। প্রত্যেকটা ছোট ছোট বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা দিতে পারব আমি। মানুষের কল্পনাগুলো হয় ব্যক্তিকেন্দ্রিক। বস্তুকেন্দ্রিক বিষদ বর্ণনা সেখানে স্থান পাওয়ার কথা নয়! তাহলে কি পুরোটাই বাস্তব? স্ত্রী-পরিবারের বাইরেও আমার একটা একান্ত গোপন জীবন রয়েছে?

আমি বিষয়টা আরও খোলাসা করে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করলাম। তারপর প্রশ্ন করলাম, “আপনার কি মনে হয়? এটা কল্পনা নাকি বাস্তব?”

“তোমার কি ধারনা?” মহিলা উল্টো প্রশ্ন করলেন।

“আমি আসলে জানিনা”। আমি হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। “তবে নিজেকে এই কয়েকদিনে যতটুকু চিনেছি বা জেনেছি তাতে মনে হয়েছে আসলে সাধারণ জীবনের যে স্মৃতি আমার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে সেটাই হল বাস্তব। গোপন অভিসারের ব্যাপারটা পুরোপুরি ফ্যান্টাসি। আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে ব্যাপারটা আসলে যাচ্ছে না! জেনি নামে আসলে আমার জীবনে কেউ নেই”।

“আমিও তাই আশা করছি”। মিসেস গোমেজকে দেখে মনে হচ্ছে একটু চমকে গেছেন। কারো ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কৌতূহলী হওয়ার ফলে এমন বিশাল কোন বিষয় বেরিয়ে আসতে পারে এটা সম্ভবত আশা করেননি।

“তবে কি জানেন? এই স্মৃতি হারানো ও ফিরে আসার মধ্যে দিয়ে একটা বিষয় খুব ভালমতো বুঝতে পেরেছি আমি”।

“কি সেটা?” মিসেস গোমেজকে আর আমার ব্যাপারে আগ্রহী মনে হচ্ছে না।

“একজন মানুষের জন্য নিজেকে একটা নির্দিষ্ট জীবনের গণ্ডিতে নিজেকে বেঁধে রাখা ঠিক নয়”। আমি অনেকটা দার্শনিকদের মত করে বলার চেষ্টা করলাম। “প্রত্যেকটা মানুষের নদীর এপার-ওপার দুটোই দেখে নেয়া উচিত”!

“ওহ জিসাস! কি বলছ তুমি? দ্যাটস টোটালি অ্যাবসার্ড”! মিসেস গোমেজকে দেখে মনে হচ্ছে রেগে গেছেন। “যদি সবাই তোমার মত করে ভাবে তাহলে পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে একবার ভেবে দেখছ? এই জগত থেকে আস্থা-ভালবাসা-বিশ্বাস সব উঠে যাবে! একজন মানুষের একাধিক জীবন থাকা উচিত নয়! এটা যাপিত জীবনে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে”!
কথাগুলো বলা শেষে মিসেস গোমেজ সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মনে হয়না আমার সাথে আর কথা বলার ইচ্ছা আছে তার। আমি আপন মনে হাসলাম! একটু আগেও মহিলা কত্ত আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন! কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসাতে ভীষণভাবে ঘাবড়ে গেছেন।

বাকিটা পথ আর কোন কথা হলনা। প্লেন ঢাকার মাটিতে ল্যান্ড করল। আমি কাস্টমসে দাঁড়িয়ে মিসেস গোমেজকে সাহায্য করলাম তার লাগেজগুলো কালেক্ট করার জন্য। ভারী ভারী বেশ কয়েকটা লাগেজ নিয়ে এসেছেন মহিলা। জীবনের বাকিটা সময় কি দুই বুড়োবুড়ি বাংলাদেশে কাটিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করেছেন নাকি?

মিস্টার ভিনসেন্ট গোমেজ রিসেপশন কাউন্টারে বসে অপেক্ষা করছিলেন। স্ত্রীর দেখা পেয়ে মুখটা হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বুড়োবুড়ি পরস্পরকে প্রবল উচ্ছ্বাসে জড়িয়ে ধরলেন। কতদিন পর দুজনের দেখা হল কে বলতে পারে?

তাদের মিলন দৃশ্য দেখা শেষে আমি রিসেপশন ডেস্কের দিকে আরও খানিকটা এগিয়ে আসলাম। হঠাৎ করেই যেন দেখতে পেলাম তাকে। স্বর্ণা! আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে! পরিপাটি করে পড়া শাড়ি, কপালে টিপ, দু-হাত ভর্তি চুরি। যেমনটি দেখেছি তাকে ফিরে পাওয়া স্মৃতির পাতায়, পারফেক্ট বাঙালী বধূ!

আমিও স্বর্ণার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। তাহলে আমার ধারনাই ঠিক। আমি খুব সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত। জেনির বিষয়টা পুরোপুরি আমার কল্প-বিলাস। প্রতিদিন একই নিয়মে গণ্ডিতে আঁটকে থাকা জীবনে একঘেয়েমি থেকে উদ্ধার পেতে নিজের অজান্তে মনের ভেতর একটা কাল্পনিক চরিত্রের জন্ম হয়েছে।

একমাত্র লাগেজটা ঠেলতে ঠেলতে স্বর্ণার দিকে আরও কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই মনে হল স্বর্ণা আসলে আমার দিকে তাকিয়ে নয়, আমার পেছনে অন্য কাউকে মধুর হাসি হাসছে! আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনটা দেখার চেষ্টা করলাম। রাহুল! আমার বাল্যবন্ধু, বর্তমান সহকর্মী। কিন্তু স্বর্ণা আমাকে ফেলে রাহুলকে দেখে হাসবে কেন?

রাহুল আমাকে টপকে গিয়ে স্বর্ণার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। আমি কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে তাদেরকে দেখছি। স্বর্ণা দু হাতে জড়িয়ে নিল রাহুলকে। রাহুল তার কপালে চুমু খেল। এতক্ষণে স্বর্ণার সিঁথির সিঁদুর নজরে এলো আমার। স্বর্ণা আসলে রাহুলের স্ত্রী! যে সাধারণ জীবনের স্মৃতি আমার মস্তিষ্কে ঘুরছে তা আসলে আমার নয়, এ জীবন রাহুলের। থলে আমি কে? আমি কি তবে একজন একা, অসহায়, নিঃসঙ্গ মানুষ? যা কিছু টুকরো স্মৃতি একটু একটু করে ফিরে আসছে আমার তার পুরোটাই আমার অলীক চিন্তা! সমৃদ্ধ এক কল্প–জগতের কাণ্ডারির বাস্তবতা ভীষণ শূন্যতায় আবৃত!

আমি রাহুল আর স্বর্ণার কাছ থেকে বিদায় দিয়ে হেঁটে চলে এলাম এয়ারপোর্টের বাইরে। তখনও জানতাম না আমার জন্য কিছু চমক এখনও বাকি। ড্রাইভিং লাইসেন্সের ঠিকানা অনুযায়ী আমি বনানীতে থাকি। দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সি ড্রাইভারদের সাথে ভাড়া নিয়ে দরদাম করছি ঠিক তখনই চমৎকার একটা নিল রঙের প্রাইভেট কার কাছাকাছি এসে কড়া ব্রেক কষে থামল। গাড়ি থেকে নামল একজন আগুন সুন্দরী। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমার কাছ থেকে মাত্র এক হাত দূরত্বে এসে দাঁড়াল জেনি!

বিদ্যুৎ চমকের মত মাথার ভেতর খেলতে থাকা কিছু অসংলগ্ন টুকরো টুকরো স্মৃতি নিমেষেই জোড়া লেগে গেল। আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ জেনির সাথে, স্বর্ণার সাথে নই! তাহলে গোপন জীবন বলে যা ভাবছি সেটাই আসলে বাস্তব! স্ত্রী- সন্তানদের নিয়ে যে ভাবনা গুলো মাথায় এসে ভিড় করছে সেটাই আসলে কল্পনা!

গোটা এয়ারপোর্ট এলাকা যেন থমকে গেছে, হা করে সব তাকিয়ে আছে জেনির দিকে। জেনি একজন ফ্যাশন ডিজাইনার, নিজেও খুব ফ্যাশন সচেতন। পরনের স্লিভলেস ব্লাউজ আর পাতলা শিফনের শাড়ি তারা দেহের ভাজগুলো লুকিয়ে রাখতে পারেনি। এই তপ্ত দুপুরে সূর্যের তেজ অপেক্ষা জেনির রূপের আগুন কয়েকগুণ বেশি প্রখর বলে বোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে স্পর্শ করলে হাতে ফোসকা পড়ে যাবে!

জেনি আহত-দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি খুব দুঃখিত রশিদ! পৌঁছাতে একটু দেরি করে ফেললাম! তুমি রাগ করেছ তাইনা?
এমন সৌন্দর্যের আধারের প্রতি কি রাগ করে থাকা যায়? আমি হাসিমুখে বললাম, ইটস অলরাইট।

তুমি হাসপাতালে থাকা অবস্থায় রাহুলদা ফোনে বলেছিলেন তোমার এক্সিডেন্টের ঘটনা। ফ্যাশন উইক চলছিল, আমি কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম, তাছাড়া তোমার সাথে যোগাযোগ করার উপায় পাচ্ছিলাম না...
আমি সবেমাত্র আবিষ্কার করেছি লক্ষ পুরুষের ঘুম হারাম করে দেয়া এক সুন্দরীর স্বামী আমি! স্ত্রীর সব অপরাধ নির্দ্বিধায় ক্ষমা করে দিতে প্রস্তুত! জেনিকে কথা শেষ করতে দিলাম না, দু পা এগিয়ে এসে একহাতে তার কোমর পেঁচিয়ে ধরে আমার গায়ের কাছে টেনে আনলাম, “বললাম না ইটস অলরাইট?”

কপট রাগে ভ্রু কুচকালো জেনি। আমার বুকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। “পাবলিক প্লেসে কি পাগলামি শুরু করলে? যাও, গিয়ে গাড়িতে ওঠো”!

জেনি উঠল ড্রাইভিং সিটে, আমি বসলাম তার পাশে। জেনি ড্রাইভার রাখেনা, যেকোনো যায়গায় নিজেই ড্রাইভ করে যায়। গাড়ি স্টার্ট দেয়ার পর থেকে সারাক্ষণ তাকেই দেখছি আমি। কল্পনার জেনির সাথে বাস্তবের জেনিকে মিলাতে চেষ্টা করলাম- বাস্তবের জেনি অনেক বেশি আকর্ষণীয়!
“কি ব্যাপার বলতো?” জেনি আড়চোখে আমাকে দেখে ঠোট টিপে হাসছে। “আজকের মত এতটা রোম্যান্টিক হতে তোমাকে আগে কখনও দেখেছি বলে তো মনে পড়েনা”!

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, তখনই পকেটে রাখা মুঠোফোন বার কয়েক কেঁপে উঠল। হাতে নিয়ে দেখলাম অচেনা নম্বর থেকে ফোন এসেছে। হয়ত এই নম্বর আমার চেনাই, ফোনের কন্টাক্ট লিস্ট গায়েব হয়ে যাওয়ায় এখন অচেনা মনে হচ্ছে।

আমি রিসিভ করলাম, "হ্যালো"।

"হ্যালো, রশিদ"? সুরেলা নারী কণ্ঠ শুনতে পেলাম।

"হ্যাঁ, বলছি"।

“সরি রশিদ। আমি না... আসলে রাহুল সামনে ছিল তো, তাই তোমার সাথে ঠিকভাবে কথা বলতে পারিনি! তুমি প্লিজ রাগ করোনা লক্ষ্মীটি”।

আমি ঘাবড়ে গেলাম! এ কোন সুরে আমার সাথে কথা বলছে স্বর্ণা?
“ইয়ে... মানে...” আমতা আমতা করছি আমি।

“তোমার জন্য একটা দারুণ খবর আছে জানো”? স্বর্ণার কণ্ঠে ব্যাপক উচ্ছ্বাস, যেন কোন টিনেজ মেয়ে এডভেঞ্চারে যাচ্ছে!

“কি খবর?” সংক্ষেপে জিজ্ঞেস করলাম আমি। স্বর্ণার আচরণের কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছিনা।

“আজ রাতের ট্রেনে রাহুল বাড়ি যাবে, জমি জমা সংক্রান্ত কি যেন একটা ঝামেলা বেঁধেছে। জিতু আর মিতুও তার সাথে যাচ্ছে। দুদিন আগে ফিরবে না। কাজের মেয়েটাকেও দু দিনের জন্য ছুটি দিয়ে দেব। তারমানে কি দাঁড়াল? বাড়িতে আমি একা”!

হাত থেকে মোবাইলটা ফেলে দিতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে সামলে নিলাম। স্পষ্ট টের পেলাম আমার গায়ের লোমগুলো সব দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কি বলছে এসব স্বর্ণা? কি বুঝাতে চাইছে সে? তারমানে কি...

হ্যাঁ... টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি এখন জোড়া লাগতে শুরু করেছে। আমার গোপন অভিসারের স্মৃতিগুলো আসলে মিথ্যা নয়! আমি সত্যিই বাড়িতে মিথ্যা বাহানা দেখিয়ে গোপনে গিয়ে প্রেয়সীর সাথে মিলিত হই। আমার সেই অভিসারের সঙ্গী জেনি নয়, স্বর্ণা!

কিন্তু কেন? জেনিকে একনজর দেখলেই যেকোনো পুরুষের রাতের ঘুম হারাম হবে! কবি সাহিত্যিকরা হয়ত এমন নারীকে দেখেই বলে ওঠেন যেন বিধাতার নিজ হাতে সৃষ্টি! সুন্দরী, স্মার্ট আর ফ্যাশন সচেতন স্ত্রী ছেড়ে আমি কেমন করে পরের স্ত্রীর সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত হলাম? কেন? কেন?
কেন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে!
মনে পড়েছে!

স্বর্ণার সাথে শাহবাগের মোড়ে আমার প্রথম দেখা হওয়ার সেই স্মৃতি কোন অলীক কল্পনা নয়! কঠিন বাস্তব! আমরা পরস্পরকে গভীরভাবে ভালবাসতাম। কিন্তু ধর্মীয় বাধার কারণে দুজনের পরিবার আমাদের সম্পর্কটা মেনে নেয়নি। স্বর্ণার পরিবার তাকে জোর করে আমারই বাল্যবন্ধু রাহুলের সাথে বিয়ে দেয়! রাহুল উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে ছিল, সে স্বর্ণার সাথে আমার সম্পর্কের কথা জানত না। রাহুল এমনকি এটাও জানত না যে তার সাথে বিয়ের সময় স্বর্ণা একমাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল!
এদিকে আমার স্ত্রী জেনি বন্ধ্যা, একটা দুর্ঘটনায় পড়ে সে সন্তান ধারণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। পারিবারিকভাবে আমাদের বিয়েটা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাকে আমি কোনদিন মন থেকে ভালবাসতে পারিনি। সুখী একজন স্বামীর ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছি প্রতিমুহূর্তে...

“কি হল? কোন কথা বলছ না কেন?” ফোনের ওপ্রান্তে স্বর্ণার অস্থির কণ্ঠ শোনা গেল।

“হ্যাঁ?... হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনছি তো”। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ, মনে হচ্ছে এক্ষুনি এক গ্লাস পানি না খেলে মরে যাব!

“তুমি জেনিকে কিছু একটা মিথ্যা বলে আজ রাতেই চলে আসবে। দেরি করবে না কিন্তু! তুমি তো জানোই যে আমি একা থাকতে ভীষণ ভয় পাই! কি বললাম বুঝেছ?”

কোনওমতে “আচ্ছা”,”ওকে”, “ঠিক আছে” ইত্যাদি বলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করলাম।

না! এ অন্যায়! বিয়ের আগে কি করেছি জানিনা, কিন্তু বিয়ের পর পরের স্ত্রীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক রাখাটা একটা জঘন্য ব্যাপার! একজন শিক্ষক হয়ে আমি এ কাজ করতে পারিনা! জেনি বন্ধ্যা তো কি হয়েছে? আমরা ইয়াতিমখানা থেকে একটা বাচ্চা পালক এনে ভরণ পোষণ করব! জেনিকে নিয়ে এ শহর ছেড়ে চলে যাব অনেক দূর! স্বর্ণার মুখ যেন আর কখনও দেখতে না হয়!

“কার ফোন ছিল?” জেনি প্রশ্ন করল।

“ইয়ে...” একমুহূর্ত ইতস্তত করলাম। আমি পারব না স্বর্ণাকে ছেড়ে থাকতে! স্বর্ণাকে আমি ভালবাসি! কোনকিছুর বিনিময়ে আমি স্বর্ণার সহচর্য ত্যাগ করতে পারব না! কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম, “ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ ফোন করেছিল। আমাদের নারায়ণগঞ্জে একটা নতুন ক্যাম্পাস চালু হচ্ছে না? ওটার সার্বিক পরিস্থিতি প্রদর্শনের জন্য দুদিনের জন্য যেতে হবে আমায়”।

“আজই?”

“হুম, আজই”।

“তুমি আপত্তি জানাতে পারলে না?” জেনি অবাক হয়েছে। “সবে তো মাত্র বিদেশ থেকে ফিরলে, একটা দিন অন্তত রেস্ট নাও! তাছাড়া তুমি তো অসুস্থ”!

“না... আসলে... ফ্যাকাল্টির ডিন আর ভিসি স্যার যে আমার উপরে অনেক ভরসা করেন তা তো জানোই”। আমি যে এত চমৎকার করে মিথ্যা বলতে পারি সে সম্পর্কে আমার কোন ধারনাই ছিলনা! “ওনাদের কথায় আমি কিকরে আপত্তি জানাই বল?”

“ওহ আচ্ছা”! বলে গাড়ি চালানোয় মনযোগী হল জেনি। অভিমানী বাচ্চা মেয়ের মত ঠোট উল্টে রেখেছে।

এরপর কিছুক্ষণ নীরবে কেটে গেল। চুপচাপ ড্রাইভ করছে জেনি। রাগ করেছে। আমার মধ্যে রাগ ভাঙানোর কোন লক্ষণ নেই। জেনিই আবার নীরবতা ভাঙল, “ঐ জিনিসটা খুঁজে পেয়েছি”।

“কিসের কথা বলছ?” আমি প্রশ্ন করলাম।

“যেটা হারিয়ে ফেলেছি বলে মাসখানেক আগে তুমি আমার সাথে খুব রাগারাগি করছিলে”!

“মানে?” আমি একটু অবাক হলাম। “আমার ঠিক মনে পড়ছে না”!

“এত জলদি ভুলে গেছ?” জেনিও অবাক হয়েছে। “তোমার আমার প্রথম দেখা হওয়ার দিন যে শাড়িটা পড়েছিলাম, ওরা খুঁজে পেয়েছি। সেই যে শাহবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম! আমার পরনে একটা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি ছিল! এখন মনে পড়েছে?”

আমি মনে হচ্ছে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি! চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলাম জেনির দিকে! শাহবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকা মেয়েটি জেনি ছিল! তাহলে স্বর্ণা এলো কোত্থেকে? কীভাবে তার সাথে পরিচয়? কেন তার সাথে সম্পর্কে জড়ালাম?

জেনি বলে চলেছে, “পুরনো কাপড় চোপড়ের একটা বাক্সের ভেতর ছিল। ভেবেছিলাম আজকে পড়ে তোমাকে রিসিভ করতে আসব। কিন্তু একটু বেশি পুরনো হয়ে গেছে বলে পড়িনি। ইচ্ছে ছিল বাসায় ফিরে তোমার সামনে পড়ব। কিন্তু সে সুযোগ তো আর পাব না! তুমি তো মহাব্যস্ত মানুষ”!

আমার মনে হচ্ছে কোথাও বিরাট একটা গোলমাল হয়ে গেছে! মস্ত বড় গোলমাল! স্মৃতির এক গোলক ধাঁধাঁয় পড়ে গেছি আমি! কোনটা স্মৃতি আর কোনটা বাস্তব তা নিয়ে এতক্ষণ দ্বিধান্বিত ছিলাম, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে স্মৃতিগুলো সব এক সাথে পাক খেয়ে গুলিয়ে গেছে!
কে স্বর্ণা?
কে জেনি?
কার সাথে কীভাবে পরিচয়?
কাকে ভালবাসি?
ওহ গড! মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে যাব!

মিসেস গোমেজ একটা কথা বলেছিলেন- “একজন মানুষের একাধিক জীবন থাকা উচিত নয়! এটা জীবনে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে”!

দেখা যাচ্ছে মহিলা ঠিক কথাই বলেছিলেন!

(সমাপ্ত)
1 like ·   •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on October 05, 2014 12:13

May 11, 2014

আমি ও আমার মা

সাধারণত মাকে নিয়ে লেখাগুলোর প্রতিটি শব্দে মিশে থাকে আবেগের ছোঁয়া, পড়লে মনটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু আমার মাকে নিয়ে যখন লিখতে বসি তখন শব্দগুলোতে আবেগের যায়গাটা দখল করে বসে হাস্যরস। কারন আমার মা হচ্ছে একজন সেই মাত্রার মজার মানুষ! মাকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া দৈনন্দিন ঘটনাগুলো আমি বিভিন্ন সময়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস আঁকারে দেই। নিচের ঘটনাগুলো মূলত ফেসবুকের সি সব স্ট্যাটাস থেকে সংকলিত। পড়লে মজা পাওয়ার নিশ্চিত গ্যারান্টি!

১। ঐটা পাশের বাসার আনটিই ছিল!


পাশের বাসার এক পিচ্চি মাইয়া আইসা আমার আম্মারে বলতেছিল, “আনটি, একটা প্রশ্ন করলে সত্যি উত্তর দিবেন?”

আম্মা আবার পিচ্চি পোলাপাইন খুব পছন্দ করে। আম্মা বলল, “অবশ্যই দিব! কি প্রশ্ন?”

“আপনি কি গান করেন?”

আমি আম্মারে জীবনে গান গাইতে শুনি নাই। কিন্তু আম্মা হাসিমুখে বলল, “হ্যা, আমি গান গাই, নাচতেও পারি”!

পিচ্চি মাইয়া আবার জিগাইল, “আপনি কি রবিন্দ্র সঙ্গীত গান?”

আমার আম্মা রবিন্দ্র সঙ্গীতের নামও শুনতে পারে না! আম্মা কইল, “হ্যা গাই তো”!

“আজকে আমাদের স্কুলের অনুষ্ঠানে যে শিল্পী রবিন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছে ওইটা আপনি ছিলেন তাইনা?”

আম্মা হাসতে হাসতে কইল, “হ্যা আমিই তো ছিলাম!”

মাইয়া তার বাসার দিকে এমন এক দৌড় দিল! অনেক দূর থেইকাও তার গলার আওয়াজ পাচ্ছিলাম, "আম্মা আম্মা! দেখছ আমার কথাই ঠিক! আজকে অনুষ্ঠানে যে শিল্পীটা রবিন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছে ঐটা পাশের বাসার আনটিই ছিল"!

আম্মা মুখে আঁচল চাপা দিয়া হাসি আটকাইল! আর আমিতো হাসতে হাসতে কাইত!!!

***
২। “তুমি গল্পের কচুও বুঝনা!”

আম্মা বলল, “তুই তো অনেক গল্প লেখস! আমার লাইফের হিস্টোরি নিয়া একটা গল্প লিখে ফেল!”

আমি বললাম, “শুনাও তোমার হিস্টোরি!”

আম্মা প্রায় সাড়ে ১ ঘণ্টা (দেড় ঘণ্টা) ধইরা আমারে তার বিরাট এক হিস্টোরি শুনাইল!

আমি হিস্টোরি শুনা শেষে বললাম, “আম্মা! তোমার এই বিরাট স্টোরি গল্প তো দুরের কথা উপন্যাসেও বেরাইব না! ধারাবাহিক ১০ খণ্ডের উপন্যাস লেখন লাগব!”

এইটা শুইনা আম্মাতো রাইগা পুরাই ফায়ার, “মাইনসে হুদাই তোমার গল্প পইড়া লাফায়! তুমি গল্পের কচুও বুঝনা! রাস্তার গাজাখোরও তোমার চাইতে ভাল গল্প লিখতে পারব!”

আমি মনে মনে কইলাম, “আল্লাহ! তুমি আমারে উডায় লও, নাইলে দড়ি ফালাও আমি বাইয়া উডি!”

***
৩। “তুমি নিজে নাক ডাকলে তোমার ঘুম ভাঙবে কেন?”

আম্মা আজকে আমার পিচ্চি ট্যাঁটনা ভাইটারে বলতেছিল, “বাবা তুমি তো দেখি ঘুমালে নাক ডাক!”

ভাই কইল, “হুহ! মিথ্যা কথা”!

আম্মা কইল, “মিথ্যা না বাবা, আমি সত্যি বলতেছি!”

ছোটভাই কইল, “তাহলে নাক ডাকার আওয়াজে তো আমার ঘুম ভেঙে যাওয়ার কথা!”

আম্মা কইল, “আজব! তুমি নিজে নাক ডাকলে তোমার ঘুম ভাঙবে কেন?”

এইবার ছোট ভাই কি কইল জানেন? কইল, “কিন্তু তুমি যখন নাক ডাক, তখন তো আমার ঘুম ভেঙে যায়”!!!!!!

আমি বহুত কষ্টে হাসি আটকাইলাম আর আম্মার চেহারা তখন দেখতে কেমন হইসিল সেই বর্ণনা নাই বা দিলাম!

***
৪। “দাঁতওয়ালা অপূর্ব”

ডিনার করার সময় আম্মা আর আমি একটা বাংলা নাটক দেখতেছিলাম। নাটকের একটা দৃশ্যতে দেখলাম, নায়িকাকে এক পোলা ফোন দিয়া ডিস্টার্ব করতেছে। পোলার গলার আওয়াজ শুনে চিনা চিনা লাগতেছিল, কিন্তু নাম মনে আসছিল না!

আমি তখন মাত্র একটা লোকমা মুখে দিতেছি, আম্মা হঠাৎ চিল্লাইয়া বলল, "বুঝছি! ঐ দাঁতওয়ালা!"

আমি ভিমরি খাইলাম! কারে আবার দাতওয়ালা বলে ডাকে আম্মা? একটু পরেই সিনেই পোলারে দেখাইল এবং আমি আবার ভিমরি খাইলাম! এইটা তো দেখি "অপূর্ব!"

আমি জিগাইলাম, "আম্মা তুমি এরে দাঁতওয়ালা বলতেছ ক্যান?"

আম্মা কইল, "এর মুখে দাঁতের কোনও অভাব আছে? দেখলেই মেজাজ গরম লাগে!"

আমি দাঁত বাইর কইরা হাসতে গিয়াও নিজেরে থামাইলাম! পাছে যদি আমারেও দাঁতওয়ালা বলা শুরু করে আম্মা!

৫। এই প্রতিভা এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল?!?

ওই পিচ্চি মেয়েটা আবার আসছিল আমদের বাসায়। আম্মা তখন রান্নাঘরে। পিচ্চি সেইখানে গিয়া আম্মারে বলতাসে, “অ্যান্টি! একটা গান গেয়ে শোনাবেন, প্লিজ!”

আমি মনে মনে কইলাম, “এইবার খাইস ধরা আম্মা! গানের তো “গ” ও জান না!চাপাবাজির ফল পাইবা এইবার”!

আম্মা কইল, “মা মনি আমার গলা ভাঙছে! গান গাওয়া যাবে না”!

পিচ্চি তো নাছোড়বান্দা! “কিচ্ছু হবে না। প্লিজ গান না। একটা রবিন্দ্র সঙ্গীত গান”।

“ভাঙ্গা গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত ভাল হবেনা”।

“তাহলে একটা হিন্দি গান গান”।

মাইয়া কি একটা “সাথ নিভানা সাথ নিভানা” মার্কা গানের কথা কইল? গানটা নাকি তার অনেক ফেভারিট!

আম্মা গুন গুন গলায় গান ধরল। আমি ২ মিনিটের জন্য বাকরুদ্ধ হইয়া গেলাম! আজব! আম্মার গানের গলা তো খারাপ না!

এই প্রতিভা এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল???

***
৬। “হ, আমার তিন পোলা! কিন্তু আপনে কেডা?!!!”

ঢাকা শহরে বাসা পালটানো যে কি ঝামেলা সেইটা তো মোটামোটি সবাই জানেন। গত দুই দিন যাবত ব্যাপক দৌড়াদৌরি করতে করতে জানটা ফাতা ফাতা হইয়া গেছে!

অবশেষে সব কিছু গুছায় নিয়া আমি আর আম্মা একটু দম ফেলতেছিলাম, এই সময় এক মহিলা আসল বাসায়। নতুন বাসা! কাউরে তো ঠিকানা দেই নাই! মহিলা কি জন্য আসছে কে জানে! মহিলা আম্মারে জিজ্ঞেস করল, "ওহ! তাহলে আপনিই নতুন ভাড়া আসছেন"!

আম্মা হ্যা-বোধক মাথা নাড়ল, খুব একটা আগ্রহ দেখাইল না। মহিলা আবার জিগাইল, "আপনার তো তিন ছেলে, তাইনা?

মহিলারে আম্মার পছন্দ হইতেছিল না। বিরস মুখে কইল, "হ, আমার তিন পোলা! কিন্তু আপনে কেডা? কই থাকেন?"

মহিলা মনে হয় এরকম টোনে কোনও কথা আশা করে নাই। তার মুখের হাসি মুইছা গেল। রোবটের মত কইল, "আমি আপনাদের বাড়িওয়ালি"!

আম্মা তো থত মত খাইয়া গেল, "ওহ তাই? ভাবি! আসেন ভাবি আসেন, বসেন ভাবি......"

মহিলা সংক্ষেপে "পরে আসব" বইলা চলে গেল। মহিলা যাওয়ার পরও আমি আর আম্মা মিনিট দুয়েক ভাবলাম, "এইটা কি হইল?" তারপর পরস্পরের দিকে তাকাইয়া অট্টহাসি দিলাম!!!

***
৭। "ও তো মেয়েমানুষ!!!”

ছোটভাই অন্যান্য দিনের মত আজও স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে জুতা,মোজা, স্কুলের ইউনিফর্ম, ব্যাগ সহ সবকিছু এদিক ওদিক ফেলে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়ল।

আর আম্মাও কিচেন থেকে দৌড়ায় আসল, "বদমাশ কোথাকার! পাশের বাড়ির মেয়েটাকে দেখেছিস? স্কুল থেকে ফিরে কি সুন্দর ব্যাগ কাপর চোপড় গুছিয়ে রাখে! জুতাটা যায়গা মত রাখে, মোজা গন্ধ হলে ধুয়ে দেয়! আর আমি এত করে বলার পরও তুই প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে বেচ্চের (আম্মার উদ্ভাবিত শব্দ) কইরা শুয়ে পড়িস!"

ছোটভাই হাসিমুখে কইল, কিন্তু আম্মা! ও তো মেয়েমানুষ! ওর কাজ কি আমাকে দিয়ে হবে?

আম্মা মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল, বদমাইশ! ও মেয়ে মানুষ? ওর বড়ভাইটাও তো তাই করে, তারে কি বলবি!

ছোটভাই শয়তানের হাসি দিয়া কইল, "আম্মা তুমিযে কি কওনা! ঐটা তো হিজলা!"

আম্মা আর কিছু কইতে পারল না! এই কথা শুইনা কি না হাইসা পারা যায়!

***
৮। কন্ডিশনারের ভক্ত!!!

আম্মারে জিগাইলাম, "আম্মা তুমি গোছলের সময় চুলে এইটা কি দেও?"
আম্মা কইল, "এইটা হইল কন্ডিশনার"।
আমি কইলাম, "এইটা দিলে কি হয়?"
আম্মার উত্তরঃ "চুল সিল্কি হয়, দেখতে ভাল দেখায়"।
আমি কইলাম, "আমিও দিমু তাইলে, এইটা দেওয়ার সিস্টেম শিখায় দেও"।

আম্মা হাইসা পুরা জিনিসটা আমারে বুঝায় দিল। "প্রথমে চুলে শ্যাম্পু করবি, তারপর কন্ডিশনার মাখবি। মাইখা শরীরে পানি দিবি, গোসল করবি কিন্তু চুলে পানি লাগাবি না। গোসল শেষে মাথাটা ভাল কইরা ধুইয়া ফেলবি, ব্যাস"।

আমি খুশি মনে কন্ডিশনার মাইখা গোসল করলাম। গোসল শেষে দেখি চুল কেমন জানি তেলতেলা হইয়া গেছে। মেজাজ খারাপ হইয়া গেল, এমনিতে চুলে তেল দেওয়া মার পছন্দ না। আজকে সাধ কইরা তেল মাখাইলাম!

কিন্তু মজাটা টের পাইলাম চুল শুকানের পর। চুলে হাত দিয়া দেখি চুল কেমন জানি সিল্কি সিল্কি লাগে! আয়নার সামনে খাঁড়াইলাম, আমার সেই রুক্ষ চুল থেইকা এখন দেখি গ্লেজ মারতাছে! বাইরে বাইর হইয়া দেখলাম অল্প বাতাসেই চুল উরতাছে! "আরি বাপরে! কন্ডিশনার তো কঠিন জিনিস!"

এইটা ছিল এক সপ্তাহ আগের কথা। এর পর থেইকা প্রতিদিনই চুরি কইরা চুলে কন্ডিশনার মাখি! আম্মা অবশ্য টের পাইছে, তয় কিছু কয় নাই! বুইঝা গেছে এর পর থেইকা একটু বেশি কইরা কন্ডিশনার কিনা লাগব, মানে কন্ডিশনারের জন্য বাজেট বাড়াইতে হইব আর কি! পোলা কন্ডিশনারের ভক্ত হইয়া গেছে!

***
৯। বুদ্ধিটা খারাপ না।

অপর্ণাপুঃ গ্রাম থেকে বাসায় ফিরছে তোমার মা?

আমিঃ হ্যা আপু। ফিরেছে। এই কয়দিন অনেক কষ্ট গেছে রান্না করা আর কাপড় ধোঁয়ার।

অপর্ণাপুঃ এই চান্সে মা কে বলতে পারতা , আম্মা তুমি বাসায় ছিলা না বহুত কষ্ট হইছে ! একটা বৌ আনো বাসায়,খ্যাক খ্যাক!

আমিঃ সেটা তো বলতেই পারি। আম্মা হয়ত রাজিও হবে কিন্তু বলবে নিজের বউরে নিজে খাওয়াবি! তখন কই যাব? বউরে খাইতে দিমু কি?

অপর্ণাপুঃ বলবা আম্মা কাজের বিনিময়ে থাকতে দিবা , সে রান্না করবো , আর তোমার বাজার আমি করে দিবো-- এই হিসাবে খাইয়াইবা!

বুদ্ধিটা খারাপ না। আমি গেলাম আমার আম্মারে কইতে। আপনেরাও টেরাই করে দেখেন!

বি. দ্রঃ মায়ের হাতে ধোলাই খেলে দোষ কিন্তু আমার না। সব দোষ বড়াপুর!

***

১০। “ছাতা বিষয়ক নিষেধাজ্ঞা”

আমার বাসায় দুইটা ছাতা। কিন্তু বৃষ্টি হলেই ভিজে যাওয়ার ভয়ে সারাদিন ঘরে বসে থাকা লাগে।

কারন কি?

কারন আমার মা ছাতা ভেজানো পছন্দ করেন না। মায়ের শুচিবাই টাইপের আছে। একান্তই বাধ্য না হলে তিনি ছাতা ভেজাতে পছন্দ করেন না। তাই বৃষ্টি হলে বেশির ভাগ সময় বাসাতেই বসে থাকতে হয়।

কেউ বাইরে গিয়ে ছাতা ভিজিয়ে এলেই, তাকে একগাদা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়:

“কোথায় গিয়েছিলি?”
“কেন গিয়েছিলি?”
“কি কাজ ছিল?”
“কাজটা কি এতই জরুরি ছিল?”
“ছাতা না ভেজাতে হতনা?”
“ভেজা ছাতা এখন রাখবি কই?”
“ছাতা শুকাবে কি করে?”

ইত্যাদি ইত্যাদি আরও কত প্রশ্ন!

কিছুক্ষন আগে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা মা। ছাতা কিজন্য ব্যবহার করি আমরা?”

মা বলল, “বৃষ্টিতে যেন না ভিজে যাই সেজন্য”।

আমি বললাম, “ছাতা না ভিজালে, বৃষ্টিতে তো নিজেই ভিজে যাব। তাহলে ছাতা না ভিজিয়ে উপায় কি?”

এর পর আরও কিছুক্ষন তাকে বিষয়টা বুঝালাম। মা দেখলাম কথাগুলো শোনার পর থেকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে আর কিছু একটা ভাবছে। সম্ভবত বুঝতে পেরেছে ছাতার জন্মই হয়েছে নিজেকে ভিজিয়ে অন্যকে শুকনা রাখার জন্য। কাল থেকে আশাকরি ছাতা বিষয়ক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে! বৃষ্টি হলে আর গোমড়া মুখে ঘরে বসে থাকা লাগবে না! <img src=

***
১১। "জর্দা থেকে আড্ডার শক্তি বেশি""

মায়ের এক বান্ধবী এসেছিলেন বাসায়। এর মধ্যে পাশের বাসার আর এক আন্টি চলে এসেছেন। তিনজনে স্টার জলসা আর স্টার প্লাসে দেখা যতসব বস্তাপচা সিরিয়ালগুলো নিয়ে বিশাল আড্ডা জমিয়ে ফেলল। খানিক বাদেই আম্মা তাদের জিজ্ঞেস করল, "কি খাবেন ভাবীরা?"

মায়ের বান্ধবী হঠাৎ বলে উঠলেন, "পান খাওয়ান ভাবী, বহুদিন পান খাওয়া হয়না"।

যথারীতি আমার ছোটভাইয়ের উপর পড়ল পান আনার দায়িত্ব। ছোটভাই পান কিনে আনল। আম্মা পান খায়না। বাকি দুজনে মিলে মজা করে পান খেল। বিপত্তি ঘটল কয়েক মিনিট বাদে।

মায়ের বান্ধবী হঠাৎ বলে উঠল, "কিরে মাথা ঘোরে কেন?"

মা ছোটভাইকে জিজ্ঞেস করল, "কি রে? পানে কি জর্দা দিয়ে আনছিস?"

ছোটভাই সৃজনশীল শুভ নিরীহ চেহারা করে বলল, "তোমরা তো আমাকে নিষেধ কর নাই। দোকানদার আমাকে জিজ্ঞেস করল, জর্দা দেব কিনা? আমি ভাবলাম বেশি জর্দা দিলে স্বাদ ভাল হবে। টাকা দিয়েই যখন কিনছি, কম নিব কেন ? তাই বেশি করে জর্দা দিতে বলেছি"।

এই কথা শুনে মহিলা বলতে গেলে মাথা ঘুরে পড়েই গেল। তাড়াতাড়ি আম্মা আর পাশের বাসার আন্টি তাকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে মাথায় পানি দিয়ে নিয়ে এল। মহিলা মায়ের বেডে হাত পা ছেড়ে শুয়ে থাকলেন।

আমি হাসি চেপে রেখে একফাকে ছোটভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, "কিরে? জর্দার কাহিনী কি?"

ছোটভাই তার ত্যাঁদড় মার্কা হাসি দিয়ে বলল, "ইচ্ছা কইরা জর্দা বেশি দিয়া আনছি। সারারাত হাবিজাবি দেখে এসে সারাদিন গল্প করে! এইবার মজা বুঝুক!"

হাসিমুখে ছোটভাইয়ের সাথে একটা হাইফাইভ দিয়ে দিলাম!

অবশ্য কামের কাম কিচ্ছু হলনা। মহিলা মিনিট দশেক বাদেই ঠিক হয়ে গেলেন। তারপর তিনজনে বিছানায় শুয়ে শুয়ে দুনিয়ার আলাপ করলেন। ৪ ঘন্টার জম্পেস আড্ডা সেরে তারা এইমাত্র উঠেছেন।

***
১২। পিতা মাতা আর একটু উদার হলে হয়ত…

আমেরিকান অভিনেতা কাম সিঙ্গার কাম ডান্সার জনি হোপকে একবার জিজ্ঞাসা করা হল, “আপনি নাচ শিখলেন কীভাবে?”

সে উত্তর দিল, “আমরা বাড়িতে ছিলাম ৬ ভাই। এ কারনেই আমি নাচ শিখতে পেরেছিলাম”।

প্রশ্নকর্তা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, “বাড়িতে ৬ ভাই থাকা আর নাচ শেখার মধ্যে সম্পর্ক কোথায়?”

জনি হোপ উত্তর দিল, “প্রতিদিন সকাল বেলা টয়লেটের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়াতে হত কিনা!”

আমারও ছোট বেলা থেকে নাচের প্রতি খুব আগ্রহ ছিল। কিন্তু পিতার নিষ্ঠুর চোখ রাঙ্গানির ভয়ে ইচ্ছেটার কথা কখনো প্রকাশ করতে পারিনি। ঘটনা হচ্ছে, আমরা বাড়িতে তিন ভাই। পিতা মাতা আর একটু উদার হলে হয়ত আরও তিনটা ভাই জুটে যেত। আর মাঝখান থেকে ফ্রি ফ্রি নাচ শিখে ফেলতে পারতাম।

এই কথাগুলো এতক্ষন খুব মজা করে মায়ের সাথে বলছিলাম। শুনে মা মজা পেল নাকি রাগ করল আল্লাহ মালুম! কথা শেষ হতে যা দেরি, আমাকে ধরার জন্য কতক্ষন আমার পিছন পিছন এঘর থেকে ওঘরে দৌড়াল। ধরতে না পেরে এখন বসে বসে হাপাচ্ছে! আমি জানি একটু পর মা আমাকে আবার ধাওয়া করবে। কতক্ষন বেঁচে থাকতে পারব জানিনা, মনে হচ্ছে আজকে আমার কপালে মাইর নিশ্চিত! হুদাই কেন যে মজা করতে গেছিলাম! :'(

***
১৪। "সওয়াব পাওয়ার আশায়"

আম্মা প্রায়ই নামাজ শেষে তসবি পড়েন। আজ মাগরিবের নামাজ শেষে আমাকে এসে বলল, "আমি আজকে মাগরিবের পর ১০০০ বার তসবি পড়েছি"।

আম্মা কথাটা এমনভাবে বলল যেন কি এক অসাধ্য সাধন করে ফেলেছে! আমি বললাম, "মাত্র ১০০০ বার কেন? আরও বেশি পড়তে পারলে না?"

আম্মা ঠোঁট উল্টে বলল, "নাহ! এর বেশি পড়লে মাথা ঝিম ঝিম করে"।

আমি দেখলাম একটা বিটলামি করার সুযোগ এসেছে! আম্মার সাথে এমনিতে কথায় পারিনা আমি। এমন সুযোগ সাধারণত খুব একটা পাওয়া যায়না। বললাম, "আচ্ছা আম্মা! মানুষ তসবি পড়ে কেন?"

"সওয়াব পাওয়ার আশায়"। আম্মার সরল উত্তর।

"যত বেশি পড়বে তত বেশি সওয়াব পাবে তাইনা?"

"হ্যা"।

"তারপরও ১০০০ বার এর বেশি পড়লে মাথা ঝিম ঝিম করে?"

"হুম"।

এইবার আমি মোক্ষম একটা চাল দিলাম, "আচ্ছা! তোমাকে যদি বলা হয়, এখানে অনেক টাকা আছে। তুই গুনতে শুরু কর। যত টাকা গুনতে পারবি সবটাকা তোর। তাহলে তো তুমি সারাদিনই টাকা গুনবে! তসবি গুনতে সমস্যা কই?"

আম্মা চোখমুখ গোল করে তাকিয়েছিল। ভয় পাচ্ছিলাম এখনই না আবার রাগে ফেটে পড়ে! আমি "বিসমিল্লাহ" বলে আস্তে করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম। আড্ডাবাজি শেষে এই মাত্র ফিরেছি। আম্মা এখনও কিছু বলে নাই, টিভি দেখছে। রাতে খেতে দিবে কিনা আল্লাহ মালুম!

***
১৫। আমি ঢাকাইয়া মাইয়া!

আম্মা অনেক দিন ধরে নানুবাড়ি যাবে যাবে করতেছে। কিন্তু হরতাল অবরোধের কারনে যেতে সাহস পাচ্ছেনা। এই শুক্রবার বা শনিবার যাবে শিওর ছিল, কিন্তু সাহস করতে পারে নাই। এমনিতে অবশ্য আমার আম্মা খুব সাহসী মানুষ। কিন্তু অবরোধের মধ্যে সাহস না দেখানোই ভাল!

আম্মা মাঝে মাঝে আমার সাহস নিয়ে কথা শুনায়। এই পচানোর সুযোগ আমি হাতছাড়া করব কেন? গতকাল রাতে অনেকক্ষণ “ভীতুর ডিম”, “বুকে সাহস নাই” আরও নানান কথা বলছি তাকে।

আজ সকালে উঠেই দেখি আম্মা ব্যাগ ব্যাগেজ গুছাতে শুরু করেছে। আর আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে, “আমারে কয় আমার সাহস নাই! আমি ঢাকাইয়া মাইয়া! ঢাকায় বড় হইছি! আমার লগে লাগতে আসে এমন বুকের পাটা কয়জনের আছে? এইসব হরতাল অবরোধ আমার লেইগা কোন বিষয়? আমি কি ককটেলের ভয় পাই নাকি? এই ভেজালের সময় পোলায় কই না কই যায়, ঠিক নাই। কাছে থাকলে একটু দেইখা শুইনা রাখতে পারমু! এই চিন্তা কইরা খালি যাই নাই! আর আমারে কয় কিনা আমার সাহস নাই...”

আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম। খাইছে রে! এই হরতালে বাইর হলে তো আর রক্ষা নাই। আমি বয়ান দিতে শুরু করলাম, “আম্মা, দেখ হরতালের মধ্যে সাহস দেখানোটা বোকামি। প্লিজ এর মধ্যে বের হইয়ো না...”

অনেক রিকোয়েস্ট করে তাকে একটু শান্ত করছি। আম্মা আবার ব্যাগ থেকে কাপড় চোপড় বের করে গুছায় রাখল।

আমি আরও একবার সুযোগ নিলাম! হে হে!

আবার বয়ান দিলাম, “হরতাল অবরোধ দেখে কি ঘরে বসে থাকতে হবে? দেশের সব মানুষ কাম কাজ ফেলে যদি ঘরে বসে থাকে তাহলে তো দেশটা অচল হয়ে যাবে! দেশের সব মানুষ এমন ভীতুর ডিম হয়ে গেল কেন কে জানে! হে হে হে!”

বয়ান দিয়াই বুঝলাম বুদ্ধিমানের কাজ হয় নাই! আম্মা অবশ্য আর বের হওয়ার জন্য ব্যাগ ট্যাগ গুছায় নাই। কিন্তু যেভাবে গাল ফুলায় রাখছে, আল্লায় জানে আজকে দুপুরে আমার কপালে খাবার জুটে কিনা! ফ্রেন্ডরা কেউ আছস নাকি? আজকে দুপুরে কেউ একজন আমারে দাওয়াত দেরে ভাই! অভুক্তরে খাওয়াইলে আল্লায় সওয়াব দিবে!

***
১৬। “প্রকাশ করলেই ফায়দা হয়”

দুদিন আগে আমার স্কুলজীবনের কাছের এক বন্ধুর বিয়ে হল। বন্ধু মহলে এটাই প্রথম বিয়ে। এর আগে অবশ্য বেশ কয়েকজন বান্ধবীর বিয়ে হয়েছে কিন্তু বন্ধুর বিয়ে হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম।

ঐ দিন বিকালে আম্মাকে বলছিলাম, “আম্মা, আজকেআমার এক বন্ধুর বিয়ে”।

আম্মা নাক সিটকে বলল, “তোর বন্ধুর বিয়ের বয়স হইছে?”

“এইটা কি বললা?” আমি তো অবাক! “সরকারী হিসেবে ২১ বছর বয়সেই বিয়ে করা যায়। জানতো নিশ্চয়ই?”

“বুঝলাম। কিন্তু বন্ধুর বিয়েতে তোর মুখ তো থাকবে হাসি হাসি! মুখ এমন কাল করে রেখেছিস কেন?”

“হাসি না আসলে জোর করে হাসব? মানুষ জন বিয়া কইরা ফেলতাছে আর আমার দিন কাটে মোটা মোটা বই পড়ে!”

আম্মা কথাটা শুনে মজা পেল। জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলল, “আহারে! তুই কি বিয়া করতে চাস নাকি? প্রেম ট্রেম করিস? মেয়ে কেমন দেখতে?”

আমি রাগী গলায় বললাম, “প্রেম করার আর সুযোগ পাইলাম কই? সারাজীবন তো কাটল বই পড়ে! ব্রিলিয়ান্ট ছেলেদেরকে মেয়েরা ভয় পায়!”

“আচ্ছা! তো এই কথা আগে বলবি না?”

আমার মনের ভেতর আশার আলো সঞ্চারিত হল! জিজ্ঞেস করলাম, “আগে বললে কি করতা?”

আম্মা হাসি মুখে বলল, “আমার কত বান্ধবীদের সুন্দর সুন্দর মেয়ে আছে! একদিন আমার সাথে যাস! তোর সাথে খাতির করায় দিব”।

আমি ভেতরে ভেতরে আনন্দে আটখানা হয়ে গেলেও বাইরে সেটা গোপন রাখলাম। বললাম, “কি যে বলনা তুমি! আইচ্ছা ঠিক আছে! এত করে যখন বলছ... নিয়ে যেও একদিন!”

(আজকের শিক্ষাঃ বাবা মায়ের কাছে মনের ইচ্ছাগুলো গোপন রাখা ঠিক নয়, প্রকাশ করলেই ফায়দা হয়!)

১৭। “বদমাইশের দল!”

আম্মা প্রথমে ছোটভাইকে ধরল।

-ঘুমাইছিস কয়টা বাজে?
-২টা।
-উঠছিস কয়টা বাজে?
-১১টা।
-বাইরে গেছিলি কয়টায়?
-৪ টায়।
-ফিরলি কয়টায়?
-৯ টায়।

আম্মা এইবার আমার দিকে ফিরল।

-ঘুমাইছিস কয়টায়?
-৩ টায়।
-উঠছিস কয়টায়?
-১২টায়।
-বাইরে গেছিলি কয়টা বাজে?
-৩টা।
-এখন কয়টা বাজে?
-সাড়ে ১০টা।
-বদমাইশের দল! তোদের জন্য আমি যুদ্ধ করতেছি, আর তোরা গায়ে বাতাস লাগাইয়া ঘুইরা বেড়াস! যেমনে খুশি সেইভাবে চলিস!

আম্মা খেইপা গেছে। এখন চুপ থাকা ভাল। কিছু বলতে গেলে রাতের খাওয়া বন্ধ করে দেবে! আমি বুদ্ধিমানের মত চুপ করে থাকলাম।

কিন্তু আমার ত্যাঁদোড় ভাইটা চুপ থাকল না। সে বলল, “তুমি যুদ্ধ কর কি দিয়া? তোমার তো পিস্তল নাই!”

আমি মনে মনে বললাম, “কি করলি রে? নিজের কপাল নিজে পুড়াইলি!”

আম্মা কতক্ষন রেগে মেগে বড় বড় চোখ করে তাকিয়েছিল। তারপর শান্ত স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, “রাতে দুই জনেরই ভাত বন্ধ!”

আমি মিন মিন করে বললাম, “আমার কি দোষ? আমি তো কিছু বলি নাই”।

আম্মা আবার ফুঁসে উঠল, “তোরই তো আসল দোষ! এই সব শয়তানি ফাইজলামির আইডিয়া তোর কাছে শিখছে। ভাল কিছু তো শিখাস নাই!”

অবশ্য শেষ পর্যন্ত আম্মা সহজ(!) শর্তে দুইজনরে খাবার দিছে! কাল থেকে ভোর ছয়টা বাজে ঘুম থেকে না উঠলে আমাদের খাওয়ার উপর লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি চলবে!

***
১৮। “ভাগ্যিস ব্যাটা সত্যিটা গোপন করছে!”

বাড়িওয়ালার ছেলে আজকে আমার আম্মার কাছে বিচার দিয়েছে, আমি নাকি তার সাথে বেয়াদবি করেছি।

আম্মা জিজ্ঞেস করছে, "কি বেয়াদবি করছে?"

বাড়িওয়ালার ছেলে বলছে, "আপনার ছেলে রাস্তার মানুষজনকে ডেকে বলেছে যেন আমাকে পুলিশ ডেকে উঠিয়ে দেওয়া হয়"!

আম্মা বাসায় এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, "তুই নাকি বাড়িওয়ালার ছেলেকে পুলিশের গাড়িতে উঠিয়ে দিতে বলছিস?"

আমি একটু আগে ছোট ভাইয়ের সাথে বাজি লেগে এই হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে একটা পাতলা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে রাস্তা থেকে ঘুরে আসছি। প্রচণ্ড শীতে আমার মেরুদন্ড প্রায় বাকা হয়ে গেছে! আমি বাঁকা মেরুদন্ড সোজা করার কসরত করতে করতে মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিলাম, "ঐ পাগল ছাগলের কথা তুমি বিশ্বাস করছ?"

আমার বাড়িওয়ালার ছেলে আসলেই একটু পাগল কিসিমের। মাথায় সামান্য সিট আছে, দুই চার জন আরাম করে বসা যায়। কিন্তু আম্মা আমার কথা বিশ্বাস করল না। রেগে মেগে বলল, "তুই কিছু না বললে সে খামাখা মিথ্যা বলবে কেন?"

"আরেহ! আজকে আমি সারাদিন বাইরে যাই নাই। তার সাথে আমার দেখাও হয় নাই!"

আসলেই তাই। আজকে সারাদিন আমি বাসায় বসে আছি। আগামীকাল মিডটারম পরীক্ষা আছে, পরীক্ষার টেনশনে বাইরে যাওয়া হয়নি। অবশ্য এখন পর্যন্ত বই নিয়ে বসিনি। <img src=

আম্মা রাগী দৃষ্টিতে কতক্ষন তাকিয়ে থাকল। আর কিছু বলল না।

আমি ভেবে কুল পেলাম না বাড়িওয়ালার পোলা হঠাৎ আমার নামে মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার পিছনে কারন কি? সকালে বাসার সামনের গাছ থেকে ফুল ছেঁড়ার সময় দেখে ফেলছিল। এটাই কি কারন? কিন্তু আম্মার কাছে "আপনার ছেলে ফুল ছিঁড়েছে" বলে বিচার দিলেই তো হত! তার কাছে হয়ত মনে হয়েছে ফুল ছেঁড়াটা আমার আম্মার কাছে বড় কোন অপরাধ বলে মনে হবেনা।

ভাগ্যিস ব্যাটা সত্যিটা গোপন করছে! আসল কথাটা আম্মা জানলে "কেন ফুল ছিঁড়েছিস?" "কার জন্য ছিঁড়েছিস?" "আগে কতবার ছিঁড়েছিস?" ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্ন করতে করতে আমার অবস্থা কাহিল করে দিত! <img src=

***
১৯। “চাপার দাঁত ফালায় দিমু”

গতকাল হঠাৎ আননোন নম্বর থেকে আসা একটা কল রিসিভ করে বললাম, “হ্যালো। কে বলছেন?”

ওপাশ থেকে বলল, “আমি তোর দুলাভাই”।

আমার রাগ হল খুব। কেউ একজন অচেনা নম্বর থেকে ফোন দিয়ে যদি বলে আমি তোর দুলাভাই তাহলে কেমন লাগে? নিশ্চয়ই কোন বন্ধু বিটলামি করতেছে। “কোন বদমাইশের বাচ্চা ফাইজলামি করতাসস?”

ওইপাশ থেকে বলল, “তুই নাজিম না?”

আমি বললাম, “হ্যা”।

“ঠিক ই তো আছে! আমি তোর দুলাভাই”।

এইবার মেজাজ সাংঘাতিক খারাপ হল। “ঐ হা..... নাতি। আমার লগে বিটলামি করলে একদম চাপার দাঁত ফালায় দিমু! তুই আমার দুলাভাই হইলি ক্যামনে রে?”

ওইপাশ থেকে উত্তর দিল, “আমি তোর দুলাভাই কারন তোর বইন রে বিয়া করছি। একটা বাচ্চাও হইছে”!

এইবার একটু বিষম খেলাম যেন। খাইছে রে! আমি যে ছোটভাইয়ের সাথে মোবাইল এক্সচেঞ্জ করছি। সিমে তো কোন নম্বর নাই! সব নম্বর মোবাইলে রয়ে গেছে। এইটা তাহলে সত্যি সত্যি দুলাভাই!

জিভে কামড় দিয়ে বললাম, “ওহ! দুলাভাই! সরি, আমি তোমারে চিনি নাই। ভাবলাম কে না কে ফাইজলামি করতেছে! আসলে ফোনটা চেঞ্জ করছি তো! কারো নম্বর সেভ নাই...”

এই যাত্রায় বেঁচে গেলাম। কারন দুলাভাই আমার কাছাকাছি বয়সের। উনিও ব্যপারটায় মজাই পেয়েছেন। কিন্তু এর পর যে ঘটনাটা ঘটল সেটা থেকে আর বাঁচা গেলনা!

আম্মা ফোন দিয়েছিল। আমি তো নম্বর চিনিনা। বললাম, “হ্যালো কে?”

আম্মা বলল, “আমার সাথে ফাইজলামি করিস? আমাকে জিজ্ঞেস করিস আমি কে?”

আমি ঠিক চিনলাম না! আমার সাথে কোন মেয়ে চিল্লায় চিল্লায় কথা বলার সাহস রাখে! এইটা নিশ্চয়ই বান্ধবী মৌরী! আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, “কে মৌরী? দোস্ত আমি তো মোবাইল চেঞ্জ করেছি। তোর নম্বর চিনতে পারিনি!”

আম্মা রেগে ফায়ার! “হারামি! আমার কণ্ঠ তুই চিনিস না? আয়! আজকে বাসায় আয়!”

পুরাই ধরা খাইলাম! নম্বর চিনি নাই সেটা সমস্যা না। মায়ের কণ্ঠ চিনি নাই এই জন্য কি শাস্তি দেয় কে জানে? অবশ্য রাতে বাসায় ফিরে দেখলাম আম্মা কাজের ঝামেলায় সব ভুলে গেছে! মানীর মান আল্লাহ রাখে!

ঢের হয়েছে ভাই! নিয়ে যা তোর ব্লাকবেরি, ফিরিয়ে দে আমার নকিয়া!

***
২০। পাকিস্তানি দরজা

বাসা ভাড়া নেওয়ার আগে আম্মা আপত্তি করছিল দরজাগুলি নিয়ে। আম্মার আবার কাঠের দরজা পছন্দ না।

কিন্তু বাড়িওয়ালা বার বার বলতে থাকল, "এই গুলা পাকিস্তানি দরজা, সহজে কিছু হবেনা ভাবি। কারো ভাঙার সাধ্য নাই। এমন নিরাপত্তা কই পাবেন?"

অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও আম্মা বাসাটা ভাড়া নিল। এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে কি ভুল করে ফেলছে!

পাকিস্তানী দরজা শালা খানদানি মাল! অল্প কয়েকদিনের মাঝেই কীভাবে যেন সাইজে বেড়ে গেছে। এখন দরজাগুলা বন্ধ করতে তিনজনের হাত লাগাতে হয়! খুলতে লাগে চারজন! কিন্তু আমরা বাসার ভেতর মানুষ হচ্ছি তিন জন! অন্য সব দরজার কথা না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু বাথরুম? প্রচণ্ড প্রকৃতির ডাক যখন আসে, তখন কি প্রেসার দিয়া দরজা আটকানো যায়??

আম্মা আজকে বারিওয়ালারে দরজা ঠিক করার আল্টিমেটাম দিয়া আসছে! কোন শালার মাথায় বুদ্ধি আসছিল পাকিস্তানী দরজা আমদানি করার? হায়রে পাকিস্তান! স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরেও তোদের জ্বালায় আর শান্তি পাইলাম না!

***
২১। “প্রতিশোধ”

আমার ডেস্কটপের মনিটরের পাশে একটা প্ল্যাস্টিকের ঝুড়ি ছিল। তাতে আমি মোবাইল, চার্জার, পেন ড্রাইভ, মানিব্যাগ, পকেট চিরুনি সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রেখে দিতাম। আজ বাইরে থেকে বাসায় ফিরে দেখি ঝুড়িটা গায়েব। ভেতরের জিনিসপত্র সব টেবিলের ড্রয়ারে রাখা! ঘটনা কি?

ছোটভাইয়ের মুখে শুনলাম আমাদের বাসার গেটের সামনে এক ফেরিওয়ালা আসছিল। সে ভাঙাচোরা কাঁচ আর প্ল্যাস্টিকের জিনিসের বদলে পেঁয়াজ বেঁচে। আম্মা তার কছে আজ বেশ কিছু প্ল্যাস্টিকের জিনিস বেঁচে দিয়েছে। আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি ব্যাপার মা? তুমি আমার ঝুড়িটা বেঁচে দিছ?”

আম্মা বলল, “হ্যা, দিয়েছি”।

“কিন্তু কেন?”

“আমার একটা বাটি হারায় গেছে তাই”। আম্মার সোজাসাপ্টা উত্তর!

গেলাম তো ফাঁইসা! ঘটনা হইছে আম্মা কিছুদিনের জন্য নানাবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। ঐ সময় আমি একা ছিলাম বাসায়। একদিন রান্নার চেষ্টা করতে গিয়ে একটা সুন্দর দেখতে বড় সাইজের বাটি ভেঙে ফেলছিলাম। আম্মা আজ আবিষ্কার করছে তার একটা সাধের বাটি গায়েব! আমি একটা ঢোঁক গিলে বললাম, “কি আজব! বাটি হারায় গেছে বইলা ঝুড়ি বেঁচে দিবা?”

“তুই আমার বাটি হারায় ফেলছস, আর আমি তোর ঝুড়ি থাকতে দিব?” মায়ের কণ্ঠে প্রতিশোধের সুর!

আমি এই প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারলাম না। তবে কিছুদিন আগে ছাঁদে কাপড় শুকাতে দিয়ে আম্মা আমার একটা জিন্সের প্যান্ট হারাইছে। আমিও হুমকি দিলাম, “আমিও তোমার একটা দামী শাড়ি নিয়া গুলিস্তানে বিক্রি করে আমার প্যান্ট হারানোর প্রতিশোধ নিব! সেই টাকা দিয়ে গ্রিল চিকেন খাব”! :v

***
২২। নতুন গেঞ্জি পাবিনা।

-মা, ১০০ টাকা দিবা?
-কেন? কালকে না তোরে ২০০ টাকা দিলাম? কি করসস টাকা দিয়া?
-বন্ধু বান্ধবদের চা খাওয়াইছি।
-চা খাইতে ২০০ টাকা খরচ হয়? আমারে মক্কা চিনাও?
-২০/২৫ জন ফ্রেন্ডরে একসাথে চা খাওয়াইতে গেলে কত খরচ হয় হিসাব করে দেখ।
-২০/২৫ জন ফ্রেন্ড চা খাইতে চাইছে তোর কাছে?
- খাইতে চায় নাই কিন্তু ফ্রেন্ডরা তো আমার আশে পাশেই থাকে! নিজে একলা চা খাওয়া যায়? তাই সবাইরে খাওয়াইছি।
- ভাল কাজ করছ, সমাজের অনেক উপকার হইছে। এখন হাইটা ভার্সিটি যাও, টাকা পাবা না।
- ঠিক আছে টাকা লাগবে না। নতুন গেঞ্জি যেটা কিনছি ঐটা কই? বের করে দাও, পড়ব।
- নতুন গেঞ্জি পাবিনা। গতকাল যেটা পড়ছিলি ঐটাই পইড়া যাহ।
-কিন্তু ঐটাতে তো ঘামের গন্ধ!
- ঐটাই তো ভাল হবে। ঘামের গন্ধে তোর আশে পাশে কোন ফ্রেন্ড আসবে না, আর কাউরে চা খাওয়াইতেও হইব না!

মজার ঘটনার তো অভাব নাই! সব দিতে গেলে তো সারাদিন শেষ!
পৃথিবীর সকল "মা" দেরকে জানাই মা দিবসের শুভেচ্ছা! <img src=
 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on May 11, 2014 22:57

April 12, 2014

নিভৃত পর্যবেক্ষক

কেডস পড়েছে: ৫৭ জন

স্নিকারস পড়েছে: ৪৮ জন

কনভাস পড়েছে: ৩৩ জন

নরমাল স্যান্ডেল পড়েছে: ২৯ জন



এখন পর্যন্ত হিসেব করে এই ফলাফল পাওয়া গেছে। ফিরোজের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ঈর্ষনীয় পর্যায়ের, হিসেবে গড়মিল হওয়ার কোন সুযোগ নেই।



ইদানীং ঢাকা শহরের মানুষের মাঝে শারীরিক ব্যায়াম সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সকাল- বিকাল দুবেলাই মানুষজন দলে দলে জিয়া উদ্যান, সংসদ ভবনের আশ পাশ, রমনা, সোহরাওয়ার্দি উদ্যান সহ অন্যান্য ছোটখাটো পার্ক আর খোলামেলা যায়গা গুলোতে এসে ভিড় করে। কারো উদ্দেশ্য হাঁটাহাঁটি করা, কেউ করে জগিং, কেউ বা আবার বিভিন্ন শারীরিক কসরতের মহড়া দেখায়। নারী পুরুষের অনুপাত মোটামুটি ৪:১। অবশ্য দিনে দিনে এই অনুপাতের ব্যবধান কমে আসছে।



সকাল বেলা হাঁটতে আসা এই সব নারী পুরুষরা সাধারণত তিন ক্যাটাগরির হয়। প্রথম ক্যাটাগরিতে ফেলতে হবে ডায়াবেটিকস ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা-জনিত রোগীদের। সারা জীবন শুয়ে বসে আরাম আয়েশে কাটিয়ে দিয়েছে, এখন রোগ ধরা পড়ার পর বাঁচার তাগিদে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সকাল বিকাল হাঁটাহাঁটি করতে বের হয়! এই ক্যাটাগরিতে সাধারণত মধ্যবয়স্ক ও একটু বেশি বয়সী মানুষদের ফেলা যায়। দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে আছে ইয়াং ছেলে মেয়ের দল। এদের বেশিরভাগকেই দেখা যায় কানে ইয়ার-ফোন গুঁজে দিয়ে জগিং করছে। ছেলেদের উদ্দেশ্য বডি ফিট রাখা আর মেয়েদের উদ্দেশ্য বলিউডের নায়িকাদের মত স্লিম হওয়া। থার্ড ক্যাটাগরির লোকেরা জগিং এর পাশাপাশি নানা ধরনের শারীরিক ব্যায়াম করে। বডি বিল্ডার গোছের লোকজন এই ক্যাটাগরিতে পড়ে। সামান্য একটু নড়াচড়াতেই কিলবিল করে লাফিয়ে উঠে সমস্ত শরীরের শক্ত মাংসপেশিগুলো নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়।



ফিরোজের আসার উদ্দেশ্য অবশ্য জগিং করা না। সে এক ঠোঙা বাদাম কিনে একটা খোলা মেলা যায়গা দেখে বসে যায়। পুরোটা সময় ধরে যারা জগিং করতে আসে তাদেরকে লক্ষ করে ফিরোজ। তাই বলে কেউ ভেবে বসবেন না যে জগিংয়ে আসা টাইট ফিট টি-শার্ট পড়া তরুণীদের বক্ষসৌন্দর্য অবলোকন করা তার উদ্দেশ্য। মনোযোগটা পুরোপুরি থাকে জগিংকারিদের পায়ের দিকে। কে কেমন ধরনের জুতো পড়ে আসে সেটা দেখাই তার উদ্দেশ্য। অবসর সময়গুলোতে পাবলিক প্লেসে বসে মানুষের পায়ের জুতো অবলোকন করা তার প্রতিদিনকার রুটিনে পরিণত হয়েছে।

“কে কেমন জুতো পড়ে সেটা দেখে তোমার কি লাভ?” এমন প্রশ্ন করলে ফিরোজের কাছ থেকে কোন সদুত্তর পাওয়া যায়না। কখনও সে বলে, “এটা আমার সখ”, কখনও বলে, “পায়ের জুতো দেখে মানুষ বিচার করার চেষ্টা করি”, কখনও কখনও বা মুচকি হাসি দিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।



অবশ্য সবসময় মানুষের পায়ের জুতোর দিকে লক্ষ করেনা ফিরোজ। এই যেমন- ভার্সিটি গিয়ে কখনোই ক্লাসমেটদের পায়ের জুতোর দিকে তাকিয়ে থাকেনা সে কিন্তু শিক্ষকদের পায়ের দিকে ঠিকই লক্ষ করে! মুল ব্যাপারটা হচ্ছে ফিরোজের সমস্ত আগ্রহ শুধুমাত্র মধ্যবয়সী পুরুষদের জুতোর দিকে। অদ্ভুত এই আগ্রহের পিছনে সঠিক কারণটা সে নিজে ছাড়া কেউ জানেনা। তাই অনেকে ব্যাপারটাকে ফিরোজের একটা সাইকোলজিক্যাল সমস্যা বলে মনে করে।



***



মনোয়ারা বেগমের সাথে শপিংয়ে যাওয়ার কথা কেউ ভুলেও চিন্তা করতে পারেনা। হাঁটতে হাঁটতে পদযুগলের অস্থি সমূহের নড়বড়ে দশা হয়! ভদ্রমহিলা যেকোনো সামগ্রীই অল্প সময়ের মধ্যে কিনতে নারাজ। দশটা- পাঁচটা দোকান দেখে অনেক যাচাই বাছাই করে অবশেষে কেনার সিদ্ধান্ত নেবেন। বেশিভাগ সময়ই দেখা যায় যে শেষ পর্যন্ত প্রথম দোকানে ফিরে গিয়ে প্রথম দেখা জিনিষটি তিনি কিনবেন! সকাল বেলা শপিংয়ে বের হলে প্রায়শই সন্ধ্যা হয়ে যায় বাড়ি ফিরতে। সারাদিন ঘুরে ঘুরে শপিং করার এতো এনার্জি এই বয়সে কোত্থেকে পান কে জানে!



কিন্তু ফিরোজ প্রায়ই বাধ্য সন্তানের মত মায়ের পিছু পিছু শপিং করতে চলে আসে। এর পিছনে আসল কারণ হল জুতোর দোকান গুলোতে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে ঘুরে দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। দোকানে সাজিয়ে রাখা জুতো দেখার প্রতি তার আগ্রহ নেই। ফিরোজ শুধু লক্ষ করে ক্রেতারা কে কেমন জুতো কিনছে, কে কেমন জুতো পছন্দ করছে।



আজ মনোয়ারা বেগম একটা নামকরা বিদেশী কোম্পানির প্রমাণ সাইজের জুতোর দোকানে ঢুকতেই, ফিরোজ এক ফাঁকে সরে এলো। কাউন্টারের কাছে গিয়ে বলল, “ভাইজান, একটু সাহায্য করবেন কি?”

কাউন্টারে বসা লোকটি অতি উৎসাহিত না হলেও আগ্রহ ধরে রাখার ভান করে জিজ্ঞেস করল, “জী বলুন কি সাহায্য করতে পারি?”

“আমাকে ভার্সিটি থেকে একটা বিশেষ এসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছে। কোন বয়সী লোকেরা কোন ধরনের জুতো বেশি কেনে তার উপরে ছোট খাট একটা জরিপ করতে হচ্ছে। আমি কি আপনাদের ক্যাশমেমোর বইটা একটু পেতে পারি?”

“জী, আমরা আসলে ব্যবসায়িক কারণে সেলস ডাটাগুলো কারো সাথে শেয়ার করিনা”।

“কিন্তু আমি তো আপনাদের ব্যবসায়ীক প্রতিদ্বন্দ্বী না। জাস্ট স্টাডির পারপাসে ডাটাগুলো ব্যবহার করব”।

“কিন্তু ব্যাপারটা আমাদের কোম্পানির পলিসির বাইরে”।

এক মুহূর্ত চিন্তা করল ফিরোজ। মনে হচ্ছে এই ভাবে হবেনা, অন্য পদ্ধতি অনুসরন করতে হবে। বলল, “দেখুন, আমার আম্মা ঘুরে ঘুরে জুতো পছন্দ করছেন। পরিবারের সবার জন্য বেশ কয়েক জোড়া জুতো কিনবেন। ভাল সময় লাগবে, এর মাঝে আমি আপনাদের ক্যাশমেমোর বইটা দেখে একটু সময় কাটিয়ে নিতে পারতাম, স্টাডির জন্য উপকারও হত”!

আসল যায়গায় টোকা দেওয়া গেছে। অনেক জুতো যখন বিক্রি হচ্ছে সেখানে সামান্য একটু নিয়মের হেরফের হলে কি এমন আসে যায়? লোকটি ক্যাশমেমোর বই এগিয়ে দিল। বলল, “এইখানে গত এক সপ্তাহের সেলস ডাটা আছে”।



ফিরোজ খুব আগ্রহের সাথে হাতে নিল। পাতার পর পাতা উল্টে কি ধরনের জুতো, কাস্টমারের নাম কি, বয়স কত ইত্যাদি দেখতে লাগল সে।



মনোয়ারা বেগমের চারজোড়া জুতো কিনতে সময় লাগল প্রায় আধাঘণ্টা। এর মধ্যে বইটা দেখে শেষ করে ফেলেছে ফিরোজ। খুঁজে পায়নি তার কাঙ্ক্ষিত তথ্যটি।



***



“গতকাল বসুন্ধরায় রিডিক মুভিটা দেখে কেমন লেগেছিল তোমার?”

“ভালই”।

“শুধু ভাল? জান আমি ভিন ডাইজেলের কত্ত বড় ফ্যান? ওর প্রায় সব মুভিই আমি ৫-৭ বার করে দেখি”!



কেয়ার কথার দিকে মনোযোগ নেই ফিরোজের। সে দূরে বসে থাকা এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তির পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা কি ধরনের জুতো পড়েছে এখান থেকে ঠিক বুঝা যাচ্ছেনা, কিন্তু জুতোর আকৃতিটা খুব পরিচিত ঠেকছে।

“কি হল? কি ভাবছ?”

“কই না তো!” কেয়ার দিকে ফিরে হাসল ফিরোজ।

“অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে তোমাকে”।

“না না। শুনছি তো তোমার কথা”!

“আচ্ছা শোননা, আমাকে ভাসানি নভোথিয়েটারে বেড়াতে নিয়ে যাবে?” আদুরে কণ্ঠে বলল কেয়া। “আমি না একবারও ওখানে যাইনি...”



ফিরোজের সমস্ত মনোযোগ এখন লোকটার দিকে। লোকটা উঠে দাঁড়িয়েছে। এদিকে ঘুরলেই তার জুতো জোড়া স্পষ্ট দেখা যাবে। এখন পর্যন্ত খুব চেনা মনে হচ্ছে।

“... কি হল? নিয়ে যাবে? শুনেছি ওখানে নাকি একটা দারুণ শো হয়। মহাকাশের কোথায় কি আছে দেখায়...”!

লোকটা ঘুরতেই একরাশ হতাশা নেমে এলো ফিরোজের চোখে মুখে। নাহ! সে যা ভেবেছিল তা নয়। জুতো জোড়ার রং বাদামী।



“...কি হল? নিয়ে যাবে কিনা বলনা”!

কেয়ার দিকে ফিরল ফিরোজ, “কোথায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলছ যেন?”

কেয়া কপট রাগে ভ্রু কোঁচকাল। “তারমানে এতক্ষণ তুমি আমার কথা শোননি?”

“আসলে একটু... একটা জিনিষ...” আমরা আমতা করছে ফিরোজ।

“তুমি নিশ্চয়ই আবার মানুষের পায়ের জুতো দেখছিলে তাইনা?”

“আরে নাহ”!

“না বললে তো হবেনা! আমি বুঝতে পেরেছি! এই জন্যই আমি টিএসসিতে বসতে বলার পরও তুমি আমাকে নিয়ে এখানে এসেছ”!

“না না কেয়া”।

“মিথ্যা বলোনা ফিরোজ”। দু সেকেন্ড থেমে থাকল কেয়া। আবার বলল, “আমি তোমাকে একদিন বলেছি আমার সাথে আর যাই কর, কখনও মিথ্যা বলবে না”।

ফিরোজ মাথা নিচু করে থাকল।

“একটা কথা সত্যি করে বল তো ফিরোজ! কেন তুমি সারাক্ষণ মানুষের পায়ের জুতোর দিকে তাকিয়ে থাক?” কেয়ার কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি।

“খুঁজি”। ফিরোজের সংক্ষিপ্ত উত্তর।

“কি খুঁজ?”

“বিশেষ একজোড়া জুতো খুঁজি”।

“তোমার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝিনা আমি। জুতো খোঁজ বলে মানুষের পায়ের দিকে অমন হাভাতের মত তাকিয়ে থাকতে হবে?”

“ঐ জুতো আমি একবারই দেখেছি, আর কারো পায়ে দেখিনি কখনও”।

কথাটা শুনে দুই সেকেন্ড অবাক চোখে চেয়ে থাকল কেয়া। তারপর হঠাৎ খিলখিল করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল।

“হাসছ কেন?”

হাসির কারণে কেয়া কথা বলতে পারছে না, মিনিট খানেক হেসে বেশ কষ্ট করে একটু শান্ত হল সে। তারপর বলল, “হাস্যকর কান্ড দেখে হাসব না?”

ফিরোজ হাসছে না। বিষণ্ণ গলায় বলল, “ধর একজোড়া জুতো তোমার খুবই প্রয়োজন। কিন্তু তুমি জাননা সেই জুতো কোথায় পাওয়া যাবে। এমন অবস্থায় কি করবে তুমি? চলতে ফিরতে মানুষের পায়ের জুতো দেখে বেড়াবে না?”

কেয়ার হাসি হাসি মুখটা হঠাৎ চুপসে গেল। আস্তে করে বলল, “মনে হচ্ছে এর পিছনে কোন ইতিহাস আছে! আমাকে খুলে বলবে ফিরোজ?”

“বলব। তবে আজ নয়, অন্যদিন”।



খানিকক্ষণ নিশ্চুপ নীরবতা। কেয়া মাথা নিচু করে বসে থাকল। ফিরোজ আবার একজন বয়স্ক লোকের জুতোর দিকে নজর মনোযোগ দিয়েছে। জুতোর রংটা অমন অদ্ভুত কেন?

“তোমার মনটা খারাপ করে দিলাম তাইনা?” কেয়ার কণ্ঠে অপরাধবোধ।

“না না, ঠিক আছি আমি”। কেয়ার দিকে না তাকিয়েই বলল ফিরোজ।

“আমার সাথে এক যায়গায় চল, তোমার মনটা ভাল করে দিচ্ছি”।

“কোথায়?”

কেয়া মুচকি হাসল, “আমার বাবার অফিসে। তোমার সাথে বাবার পরিচয় করিয়ে দিব”।



কেয়ার কথা শুনছে না ফিরোজ। একজন ভদ্রলোকের পায়ে একজোড়া চমৎকার ডিজাইনের জুতো দেখতে পেয়েছে সে।



***



কেয়ার বাবা মকবুল আহসান একটা বেসরকারি ব্যাংকের গুলশান ব্রাঞ্চের ম্যানেজার। আলিসান অফিসে ঢুকে নার্ভাস বোধ করছে ফিরোজ। কেয়া কি হিসেবে তাকে বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে কে জানে! ফ্রেন্ড হিসেবে পরিচয় করালে ঠিক আছে, কিন্তু বয়ফ্রেন্ড বললে লজ্জায় পড়ে যাবে সে।



কাঁচ দিয়ে ঘেরা একটা কামড়ায় বসেন মকবুল আহসান। বাইরে ফিরোজকে বসিয়ে রেখে ভেতরে ঢুকল কেয়া। খানিকবাদে দরজা খুললে উঁকি দিল আবার। বলল, “বাবা তোমাকে ভেতরে ডাকছেন”।



ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকল ফিরোজ। মকবুল আহসান অমায়িক ভঙ্গিতে হাসলেন তাকে দেখে, “বস ইয়াং ম্যান”।

বসল ফিরোজ। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে কিন্তু নার্ভাসনেস কাটছে না। কি বলেছে কেয়া? ফিরোজের সাথে তার সম্পর্ক কি? ফ্রেন্ড নাকি অন্য কিছু?



মকবুল আহসান মেয়ের দিকে ফিরে বললেন, “তুই অফিস ঘুরে দেখ যাহ, আমি ফিরোজের সাথে কথা বলছি”।

“আচ্ছা” বলে ফিরোজের দিকে ফিরে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেল কেয়া। ফিরোজ আবিষ্কার করল এসি রুমের মধ্যে বসে থেকেও দরদর করে ঘামছে সে।

মকবুল আহসান তার মুখের অমায়িক হাসিটুকু ধরে রাখলেন। “তারপর বল ফিরোজ, কেমন আছ?”

“জী ভাল”। খুব আস্তে করে উত্তর দিল ফিরোজ।

“কেয়া আর তুমি কি ক্লাসমেট?”

“জী না। আমি দুই ব্যাচ সিনিয়র”।

“আচ্ছা! তা লেখাপড়া তো বেশি বাকি নেই। সামনে কি করবে কোন প্ল্যান করেছ?”

“জী না। এখন ওসব নিয়ে ভাবিনি”।

“ভাবতে হবে তো! ভবিষ্যতের ভাবনা এখন থেকে না করলে বিপদে পড়বে শেষে”!

কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছেনা ফিরোজ। তবে মনে হচ্ছে কেয়া তাকে বয়ফ্রেন্ড হিসেবেই পরিচয় করিয়েছে অথবা ফ্রেন্ড বললেও তার বাবা আসল ব্যাপারটা ধরে ফেলেছেন। কোনমতে উত্তর দিল, “জী... এখন থেকে ভাবব”।



চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন মকবুল আহসান। “আমি যখন ঢাকা শহরে এসেছিলাম, তখন আমার কাছে কত টাকা ছিল শুনবে?”

“জী শুনব”। যদিও শোনার ইচ্ছে ফিরোজের নাই।

“মাত্র ২০ টাকা। আমি লাইফে অনেক স্ট্রাগল করেছি ফিরোজ! কত্ত বেলা যে না খেয়ে থেকেছি...”



অতীত স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে আহসান সাহেব মনে হচ্ছে যেন সেই অতীতেই ফিরে গেছেন! সারা অফিস রুমে পায়চারী করছেন আর কথা বলছেন। কিছুক্ষণ শোনার পরই বিরক্ত হয়ে গেল ফিরোজ। তবু একজন মনযোগী স্রোতার ভূমিকায় অভিনয় করতে হচ্ছে তাকে!

“আমি চাকরীর জন্য হন্যে হয়ে এই অফিস থেকে ঐ অফিস ঘুরেছি। মামা চাচার জোর ছিলনা, ঘুষ দেয়ার ক্ষমতা ছিলনা...”



রুমের এই কোনা থেকে ঐ কোনায় হাঁটছেন মকবুল আহসান। হঠাৎ তার পায়ের দিকে নজর গেল ফিরোজের। মারাত্মক বৈদ্যুতিক শক খেলে যেমন হয় তেমন একটা অনুভূতি ছড়িয়ে গেল ফিরোজের সমস্ত শরীরে। মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠল!

এই সেই জুতো!



নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছেনা ফিরোজের!



এই সেই জুতো!



এত্তদিন যে জুতো খুঁজে বেড়াচ্ছে ফিরোজ!



এই সেই জুতো!



***



১২ বছর আগে...



বাবা- মা জরুরী কারণে দুদিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে গেছেন। বাসায় ফিরোজ আর তার বড়বোন শেফালী থাকে। ফিরোজ পড়ে ক্লাস সিক্সে আর শেফালি ইন্টারের ছাত্রী। দু ভাইবোনের মধ্যে সখ্যতা ঈর্ষনীয় পর্যায়ের। ফিরোজ তো শেফালিবু বলতেই অজ্ঞান। মা খুব ভাল করে বলে গেছেন এই দুই দিন একান্ত প্রয়োজন না হলে যেন বাইরে বের হয় তারা কেউ। ফ্রিজে রান্না করা খাবার রেখে গেছেন। সময় হলে একটু গরম করে নিয়ে দুই ভাইবোন খেয়ে ওঠে।



এক রাতের কথা। ফিরোজের খুব পানির তেষ্টা পেল। রুম থেকে বেরিয়ে কিচেনের দিকে আসতেই শেফালীবুর রুম থেকে কেমন যেন একটা শব্দ শুনতে পেল। প্রথমে আমলে নিলনা ফিরোজ কিন্তু শব্দটা দ্বিতীয়বার শোনার পর আগ্রহী হয়ে উঠল। এগিয়ে গেল রুমের দিকে, দরজার কাছে আসতেই টের পেল শব্দটা এখন আরও বেশি স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। একবার ভাবল দরজায় টোকা দেবে, কিন্তু কিছু একটা ভেবে নিজেকে বিরত করল ফিরোজ। দরজার কি-হোলে চোখ রাখল ভেতরে কি হচ্ছে দেখার উদ্দেশ্যে।



ভেতরে অল্প পাওয়ারের একটা ডিম লাইট জ্বলছে। সেই আলোতে ফিরোজ দেখল একজন পুরুষ মানুষ তার বুবুর ওপর শুয়ে আছে। অল্প আলোতে ঠিক মত বোঝা যাচ্ছেনা। কিন্তু মনে হচ্ছে দুজনের কারো শরীরে কাপড়-চোপড় নেই। সে বয়সে ফিরোজের নারী পুরুষের দৈহিক মিলন সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারনা ছিলনা। কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে তার বুবু অচেনা একটা লোকের সাথে এমন কোন কাজ করছে যা অনৈতিক।

লোকটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। শুধু মেঝেতে লোকটার একজোড়া জুতো পড়ে ছিল। এমন চমৎকার ডিজাইনের জুতো সচরাচর চোখে পড়েনা। কালো আর লাল রঙে মেশানো চামড়ার জুতো। জুতোর সোলের চারিদিকে সাদা রঙের বর্ডার করা।

এই ঘটনার ৭-৮ মাস পরে একদিন ছাঁদ থেকে লাফিয়ে পরে শেফালী আত্মহত্যা করে। সেই বয়সে ফিরোজ বুঝতে পারেনি তার বুবুর আত্মহত্যার কারণ।



অবশ্য একটা সময় পুরো ঘটনাটা বুঝে নিতে আর কোন সমস্যা হয়নি ফিরোজের। তার বোন শেফালী মৃত্যুর সময় প্রেগন্যান্ট ছিল। এই জন্য দায়ী সেই লোকটার আর কোন খোঁজ খবর পাওয়া যায়নি। নরপশুটা শেফালীকে ধোঁকা দিয়ে পালিয়েছে। তাই লোকলজ্জার ভয়ে শেফালী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল।

সেদিন লোকটাকে অন্ধকারে চিনতে পারেনি ফিরোজ। কিন্তু তার জুতোজোড়া স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল। সেই থেকে ফিরোজ এই শহরের অলি গলি ঘুরে মানুষের পায়ে পায়ে খুঁজে বেরায় ঐ জুতো! হতে পারে লোকটি আর সেই জুতো পড়েনা, হতে পারে ঐ একই জুতো অন্য অনেকেই পড়ে, কিন্তু ফিরোজের কি করার আছে? লোকটাকে খুঁজে পেতে হলে জুতো খোঁজা ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই তার সামনে!



এতদিনে সেই জুতোর সন্ধান মিলেছে!



এই সেই জুতো!



***



“কেয়া, বলতো আমি এখন কোথায়?”

“তোমার রুমে”।

“জী না”।

“তাহলে কোথায়?”

“তোমার বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছি”।

“বল কি?” অবাক হল কেয়া। “এত রাতে এখানে কি কর?”

“তোমাকে একবার দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল”। আদুরে কণ্ঠে বলল ফিরোজ।

“কিন্তু এতো রাতে আমাকে দেখবে কি করে?”

“একটু নিচে নেমে গেট খুলে দাওনা। দারোয়ান তো ঘুমিয়েছে, কেউ টের পাবেনা”।

“আব্বা জানতে পারলে আমাকে মেরে ফেলবেন”। যদিও রাগ করার ভান করছে কেয়া কিন্তু গভীর রাতে মিষ্টি মধুর অভিসারের কথা চিন্তা করে তার সমস্ত শরীরে কেমন যেন একটা ভাল লাগার অনুভূতি খেলে যাচ্ছে!

“আরেহ না! কিচ্ছু হবেনা। কেউ টের পাবেনা, আর পেলেই বা সমস্যা কি? আঙ্কলের সাথে সেদিন আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছ না? উনি তো আমাকে খুব পছন্দ করেছেন”। অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে শব্দ করে হাসল ফিরোজ।



খানিকবাদে কেয়া এসে গেট খুলে দিতেই ফিরোজ ভেতরে ঢুকে তাকে দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

“আরেহ কি করছ”! কেয়ার কণ্ঠে রাগ নয়, ভাললাগার প্রকাশ।

“তোমাকে এই মুহূর্তে একনজর দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল! তাই না এসে আর পারলাম না।“

“ইস! এমন পাগল আর দেখিনি! এখানে না, আমার রুমে চল”। কথাটা বলেই লজ্জা পেয়ে গেল কেয়া।



চারতলা বাড়িটিতে কেয়ারা একাই থাকে। উপরের তালা দুটি সম্পূর্ণ খালি পড়ে আছে। নীচ তলায় গেস্টদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কেয়ার মা নেই, মারা গেছেন বছর তিনেক আগে। বাবা আর সে থাকে দোতালায়।



কেয়ার পিছু পিছু দোতালায় উঠে এলো ফিরোজ। তার হাতে একটা ব্রিফকেস। কেয়ার রুমে ঢোকার পর ব্রিফকেসটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে আবার জড়িয়ে ধরল তাকে। কেয়া বাঁধা দিচ্ছেনা। কয়েক মুহূর্ত আর মুখে কোন কথা হলনা দুজনের।

এক ফাঁকে কেয়া প্রশ্ন করল, “ঐ ব্রিফকেসে আছে কি”?

“তোমার...” ফিরোজের কণ্ঠে শুনে মনে হচ্ছে মাদকের নেশায় বিভোর। “তোমার জন্য একটা গিফট এনেছি”।

“দেখাও না”। আহ্লাদী কণ্ঠে বলল কেয়া।

“এখন দেখাব না। একটু পরে...”



কেয়ার শ্বাস প্রশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। সে আবেশে দুচোখ বন্ধ করে ফেলেছে। সুযোগটা চিনতে ভুল হলনা ফিরোজের। পকেট থেকে ক্লোরোফোম মিশ্রিত রুমাল বের করল। চেপে ধরল কেয়ার নাকে মুখে।



১০ সেকেন্ডের মধ্যে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ল কেয়া। তাকে আস্তে করে ধরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল ফিরোজ। অর্ধেক কাজ শেষ হয়েছে।



বিছানায় শুয়ে নাক ডেকে ঘুমচ্ছিলেন মকবুল আহসান। প্রত্যেকবার প্রশ্বাস নেওয়ার সাথে সাথে ভুঁড়িটা যেন এক হাত উঁচু হয়ে যাচ্ছে। ক্লোরোফোম মিশ্রিত রুমাল টা নাকে চেপে ধরার ১০ সেকেন্ডের মধ্যে তার শ্বাস- প্রশ্বাস ভারী হয়ে আসল। অর্থাৎ জ্ঞান হারিয়েছে।



এবার রুমাল ফেলে ব্রিফকেসটা খুলল ফিরোজ। ভেতর থেকে ছোট আকৃতির একটা ইলেকট্রিক করাত বের হল। করাতের সকেটটা হাতে নিয়ে রুমের ভেতর প্লাগের খোঁজে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সে। দু ঠোঁটের ফাঁক গলে বেরিয়ে এসেছে কয়েকটা জান্তব দাঁত। দুচোখে জ্বলছে একশো পৃথিবী পুড়িয়ে দেওয়ার আগুন!



এবার প্রতিশোধ নেবার পালা! নিভৃত পর্যবেক্ষকের একটি মহান দায়িত্বের এখানেই সমাপ্তি।



***



সাধারণত আজাদ স্যার কখনও ক্লাসে আসতে দেরি করেন না। ফিরোজ ভেবেছিল আজ আর ক্লাস পাবেনা। কিন্তু কপাল ভাল আজার স্যার কোন কাজের ঝামেলায় পরে হয়ত একটু দেরি করছেন আজ! ফিরোজ ক্লাসে ঢুকতেই তাকে দেখে এগিয়ে এলো সবচেয়ে কাছের বন্ধু জাহিদ। “কি রে? আজকে তোকে খুশি খুশি লাগছে যে খুব”।

ফিরোজ হাসল, “একটা দায়িত্ব কাঁধ থেকে নেমে গেছে দোস্ত”!

“কি দায়িত্ব?”

“তোর শুনতে হবেনা”।

“আচ্ছা না বলতে চাইলে বলিস না!” ফিরোজের কাঁধে হাত রেখে বলল জাহিদ। “অন্তত এটাতো বল যে আজ সকালে রমনায় গিয়ে মানুষের পায়ে কোন ধরনের জুতো বেশি দেখলি?”

ফিরোজ নিঃশব্দে হাসল।

“হাসছিস কেন?”

“আজ রমনায় গিয়েছিলাম ঠিকই, অনেক দিনের অভ্যাস সহজে যাবে না! তবে মানুষের পায়ের জুতো দেখিনি আজ, নিজেই ব্যায়াম করেছি”!



জাহিদ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ক্লাসে স্যার চলে এলেন দেখে আর কথা হলনা।



আজাদ স্যার প্রজেক্টরে পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইড ওপেন করে এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট ব্যারিয়ার সম্পর্কে আলোচনা শুরু করলেন। বেশ ইন্টারেস্টিং একটা টপিক, ফিরোজ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি খাতায় টুকে নিচ্ছিল। হাত ফসকে কলমটা পরে গেল। নিচু হয়ে কলমটা তুলতে গিয়ে পাশের চেয়ারে বসে থাকা বন্ধু জাহিদের পায়ের দিকে নজর গেল তার। এবং প্রায় সাথে সাথেই জমে গেল ফিরোজ, কলম তুলতে ভুলে গেছে যেন!



জাহিদের পায়ে কালো আর লাল রঙের ডিজাইন করা চামড়ার জুতো। সোলের চারিদিকে সাদা রঙের বর্ডার। খুবই চমৎকার আর আনকমন টাইপের জুতো। বাকিটা ক্লাসে আজাদ স্যার কি বললেন তার এক বর্ণও কানে ঢুকল না ফিরোজের। তার সমস্ত মনোযোগ একীভূত হয়ে আছে পাশে বসা বন্ধু জাহিদের জুতোর দিকে।



ক্লাস শেষ হতেই জাহিদকে পাকড়াও করল ফিরোজ, “এই জুতো তুই কোথায় পেয়েছিস জাহিদ?”

“নতুন কিনলাম। সুন্দর না?”

“হ্যা, কিন্তু এই ডিজাইনটা তোর পছন্দ হওয়ার কি কোন কারন আছে?”

“আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার আব্বুর এই ডিজাইনের একজোড়া জুতো ছিল। পরে বাটা কোম্পানি এই মডেলের জুতো উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছিল। অনেক বছর পর আবার বাজারে এনেছে”।



ফিরোজ যেন অন্য কোন জগতে চলে গেছে। গতকাল আহসান সাহেবকে তার প্রাপ্য শাস্তি দিয়ে এসে নিজেকে খুব হালকা লাগছিল, কিন্তু আজ আবার তার ভেতরের পৃথিবীটা নড়ে গেছে!

“কিরে ঝিম মেরে গেলি কেন?”

“কিছুনা! কাল তো ভার্সিটি বন্ধ তাইনা?” প্রশ্ন করল ফিরোজ।

“হ্যা”।

“ তুই তো অনেকদিন ধরে বলছিলি এক রাত তোর বাসায় থাকা জন্য, সারারাত কার্ড খেলে কাটায় দিবি”।

“হ্যা। আসবি আজকে?”

“হুম। আসা যায়, কিন্তু আঙ্কেল কি বাসায় থাকবেন?”।

“থাকবে, কিন্তু সমস্যা নাই, আব্বু কিচ্ছু টের পাবেনা”।



ফিরোজের ঠোঁটের কোনে হালকা হাসির আভাস! “ঠিক বলেছিস, কিচ্ছু টের পাবেন না উনি”!

ফিরোজের হাসির মর্ম বোঝেনি জাহিদ। রাতটা দারুণ কাটবে ভেবে উত্তেজিত হয়ে পড়েছে সে। “মহসিন আর আফজালকেও ডাকব নাকি? বেশি মানুষ হলে জমবে ভাল”।

“ডাকিস...”



***



মায়ের কাছে “রাতে বাসায় ফিরব না” বলে বের হল ফিরোজ। জাহিদের বাসায় থাকার প্ল্যান হয়েছে। সারারাত ম্যারাথন “টুইনটি নাইন” চলবে। আফজাল আবার লালপানির ব্যবস্থা করেছে! কেরু কোম্পানির ভদকা। খুব কড়া স্বাদ, গিলতে বেশ বেগ পেতে হয়। কিন্তু দু ঢোঁক পেটে নামতেই অল ক্লিয়ার!



প্যান্টের বা পকেটে বড় সাইজের রুমাল আর ডান পকেটে ছোট্ট একটা ক্লোরোফোমের শিশি। আর হাতে যথারীতি ব্রিফকেসটা আছেই।



বিশুদ্ধ চিন্তা ভাবনার গায়ে আচর কেটেছে প্রতিশোধ স্পৃহার দূষণ। ফিরোজ যাচ্ছে প্রতিশোধ নিতে। একজন নিভৃত পর্যবেক্ষক তার পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত ইতিবাচক তথ্যের সদ্ব্যবহার করতে যায়। তা নাহলে নিজের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার অপমান হবে যে!



শেফালী বুবুর মৃত্যুর জন্য দায়ী লোকটাকে চেনে না ফিরোজ। শুধু জানে সেই নরপশু একটা নির্দিষ্ট ডিজাইনের জুতো পড়ত। সুতরাং ঐ ডিজাইনের জুতো পড়া সবাইকে ঘৃণ্য শাস্তি দেওয়ার পণ করেছে সে। এভাবেই হয়ত একসময় আসল লোকটি তার প্রাপ্য শাস্তি পেয়ে যাবে। আর সেই সাথে বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়ার কাজটি সম্পন্ন হবে।



একজন দোষীর শাস্তি নিশ্চিত করতে গিয়ে কিছু নির্দোষকে বলি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফিরোজ। স্বাভাবিক চিন্তা ক্ষমতা লোপ পেয়েছে তার। শুধু মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে-



এই সেই জুতো!



লাল আর কালো রঙের ডিজাইনের চারিদিকে সাদা বর্ডার!



এই সেই জুতো!



(সমাপ্ত)



***



উৎসর্গঃ প্রিয় ব্লগার মাহমুদ ০০৭

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 12, 2014 23:04

February 15, 2014

মৃত্যুপথ (Based on Actual Characters)

“দা প্রিপারেশন প্রসেস”

প্রতিদিন অফিসের একঘেয়ে কাজগুলো কখনও কখনও খুব বিরক্তিকর একটা সিনেমা দেখার চাইতেও জঘন্য মনে হয়। তার উপর যদি হঠাৎ কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় প্রতিদিন ১২ ঘণ্টার বেশি সময় অফিসে কাটানোর প্রয়োজন পড়ে, কর্মচারীদের নাভিশ্বাস অবস্থা সৃষ্টি হওয়াটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। সরকারী অফিসের বড় কর্মকর্তাদের দেখলে মাহতাবের খুব হিংসে হয়। ৯ টার ডিউটি শুরু করা যায় ১০ টায় বা আরও পরে। যতই কাজের চাপ থাকুক বিকেল ৫টা বাজতেই বাড়ির পথে রওনা দেয়া যায়। মাঝের সময়টাতে ছোট খাট একটা ঘুম দিয়ে নিলেই বা ক্ষতি কি? কেউ কিচ্ছু বলার নেই।

ট্যাক্সিটা হঠাৎ হাইওয়ে ছেড়ে ছোট রাস্তায় ঢুকে পড়লে হাফ ছেড়ে বাঁচল মাহতাব। রাস্তার দুধারে পরিচিত দৃশ্য। অফিস থেকে বাড়ির ফেরার এই মুহূর্তটুকু তার কাছে স্বর্গ হাতে পাওয়ার মত। আজও ফিরতে ফিরতে রাত ১০ টা বেজে যাবে। রিশান নিশ্চয়ই ঘুমই পড়েছে। বেচারা একদিনও বাবার দেখা পায়না। সপ্তাহে একটা ছুটির দিন না থাকলে হয়ত নিজের বাবা কে চিনতেই পারত না সে! বেসরকারি ফার্মের চাকুরীতে কেবল একটাই সুবিধা পেয়েছে মাহতাব। মাস শেষে ভাল মাইনে আসে পকেটে। এছাড়া তার কর্মজীবনে আনন্দ করার মত উপলক্ষ খুব বেশি নেই।

বাড়ির গলি-মুখ দেখা গেল। কিন্তু ড্রাইভার হুশ করে সেটা পেড়িয়ে গেল। কি ব্যাপার? লোকটা কি রাস্তা হারিয়ে ফেলল? সম্ভবত ঘুরপথে যাচ্ছে। সেটাই ভাল। ইদানীং এইদিকটাতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বেড়ে গেছে। শর্টকাট গলি-চিপা ধরে না যাওয়াই উত্তম। বাসাটা পরিবর্তন করা জরুরী হয়ে পড়েছে, সময়ই হচ্ছেনা বাসা খোঁজার!

কিন্তু ড্রাইভার যখন পরের বড় গলিটাও পেড়িয়ে গেল তখন মাহতাবের সন্দেহ দৃঢ় হল। ড্রাইভার মনে হচ্ছে বাসা চেনেনা। প্রশ্ন করল ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে, “কি ব্যাপার ভাই? যাচ্ছেন কোথায়? রাস্তা চেনেন না?”

ড্রাইভার জবাব দিলনা, গাড়ির ড্যাশ বোর্ড খুলল কিছু একটা বের করল। মাহতাব দেখল ড্রাইভার মুখে একটা মাস্ক লাগাচ্ছে। বিপদের গন্ধ পেল সে কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ড্রাইভিং সিটের পাশে ফেলে রাখা একটা টিউবের মুখ খুলে দিতেই বক বক করে ধোঁয়ায় ভরে গেল গাড়ির ভেতরটা। সেই ধোঁয়া নাকে মুখে প্রবেশ করতেই বার কয়েক কেশে উঠল মাহতাব। কয়েক সেকেন্ড বাদেই তার দেহটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেল গাড়ির ব্যাকসিটে।

ট্যাক্সিটা আবার প্রধান সড়কে তুলে আনল ড্রাইভার। শহরের বাইরে অনেক দূর যেতে হবে তাকে। এই সময় মাহতাব সজ্ঞান থাকলে দেখতে পেত ড্রাইভারের ঠোঁটের কোনে অদ্ভুত এক টুকরো হাসি ফুটে আছে!

***

মুয়াজ্জিনের দরাজ কণ্ঠের মাগরিবের আযান ভেসে আসতেই মোড়ের চায়ের দোকানে আড্ডার আসর বসায় একদল চাকুরী সন্ধানী যুবক। তবে আড্ডাটা মূলত জমে ওঠে রাত আটটার পর। এলাকার বেকার সমাজের সভাপতি গফুর ভাই এই সময় চলে আসেন। গফুর ভাই যদিও পুরোপুরি বেকার নন, ছোট খাট একটা ফোন ফ্যাক্সের দোকান চালায়; তবুও তিনি নিজেকে বেকার ঘোষণা করেছেন এবং সব সময় এভাবেই থাকতে চান।

গফুর ভাইকে বেকার সমাজের সভাপতি করার পিছনে প্রধান কারণ এই আড্ডার আসরের চা- সিগারেটের তিনিই একমাত্র পৃষ্ঠপোষক। উনি নিজেই অবশ্য সবচেয়ে বড় সিগারেট-খোর। ক্রমাগত ধোঁয়া টানার ফাঁকে অনর্গল কথা বলেন আর খুব হাসেন।
আরিফকেও ঠিক সেই অর্থে বেকার বলা যাবেনা। মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে কেবল। অনার্স শেষে কিছুদিন চাকরীর খোঁজে ছুটেছে, কুল কিনারা না হওয়ায় শেষে ঠিক করেছে মাস্টার্স কমপ্লিট করে ফেলবে। ঘণ্টার কাটা ১০ এর ঘরে পৌঁছে জম্পেশ এই আড্ডার পরিসমাপ্তি টানে। একে একে সবাই যে যার বাড়ির দিকে রওনা করে।

ঘড়িতে সময় বলছে ১০টা ১৫ মিনিট। প্রমাদ গুনল আরিফ। আজও বাড়ি ফিরতেই একগাদা গালাগাল শুনতে হবে বাবার মুখে। “অপদার্থ”, “ননসেন্স”, “উজবুক” শব্দ গুলো খুব বেশি ব্যাবহার হবে তখন। বাবা ইদানীং খুব খিটখিটে স্বভাবের হয়ে গেছেন। পান থেকে চুল খসলেও আর রক্ষা নেই। বার্ধক্য মানুষের সব চেয়ে বড় শত্রু।

গলির মাথায় একটা পিক-আপ ভ্যান পার্ক করে রাখা আছে। অন্ধকার কোনে দাঁড়িয়ে একটা লোক সিগারেট ফুঁকছে। এদিকে লোকটাকে আগে কখনও দেখেনি আরিফ। হয়ত এদিকে নতুন উঠেছে। অথবা হয়ত বউ এর কাছ থেকে লুকনোর জন্য বাসা থেকে দূরে এসে সিগারেট ধরিয়েছে, হয়ত অন্য কিছু... বেকার মানুষের এসব নিয়ে চিন্তা করার কি দরকার?

আরিফের বাসা গলির শেষ মাথায়। কিছুদূর এগিয়ে আসতেই তার মনে হল পেছন পেছন কেউ একজন আসছে! ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করল সে। ঐ লোকটাই! এখনো সিগারেট ফুঁকছে। ছিনতাইকারী নয়ত? হাঁটার গতি বাড়াল আরিফ। পেছনে পায়ের আওয়াজে বুঝল লোকটাও জোরে হাটা ধরেছে! দৌড় দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল আরিফ, বাসা তো কাছেই তার।
কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে একটু দেরি হয়ে গেল। হঠাৎ পেছন থেকে শক্ত কিছু একটা দিয়ে তার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করা হল। আরিফ হাঁটু ভাজ হয়ে পড়ে গেল। কপালটা ভীষণভাবে ঠুকে গেল রাস্তার পিচে। পরক্ষনেই জ্ঞান হারাল সে।

লোকটা ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। আরিফের নিস্তেজ দেহটা কাঁধে তুলে। গলির মাথায় পিক আপ ভ্যানটা সে নিজেই দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আপাতত তার গন্তব্য অতটুকুই। তারপর পাড়ি দিতে হবে অনেক দূরের পথ!

পূর্ব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে!

***

“দা গেইম বিগিনস্”

ঘরের কোনায় একটা অল্প পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। তার আলো সমস্ত ঘরকে আলোকিত করার জন্য যথেষ্ট নয়। আধো অন্ধকার-আধো আলো মিলিয়ে সমস্ত ঘর জুড়ে এক ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। জানালা-বিহীন ঘর, একটি মাত্র দরজা বাইরে থেকে আটকানো। আলো বাতাস চলাচলের জন্য একটা ভেন্টিলেটর আছে কিন্তু তাতেও বাঁধা বসিয়েছে মাকড়শার জাল।

ঘরের ঠিক মাঝখানে অযত্নে ফেলে রাখা একটি পুরনো ঘুণে ধরা কাঠের টেবিল। তার দুপাশে মুখোমুখি বসানো রয়েছে দুটো হাতল বিশিষ্ট চেয়ার। দুজন মানুষ অচেতন হয়ে পড়ে আছে, তাদের হাত পা গুলো চেয়ার সাথে বেশ শক্ত করে বাঁধা। দু প্রান্তে দুটো দৈনিক পত্রিকার পাতা থেকে কাটা অংশ পড়ে আছে আর টেবিলের ঠিক মাঝ বরাবর নগ্ন হাসি হাসছে একটা পয়েন্ট থ্রি টু ক্যালিবারের ওয়ালথার পি পি কে পিস্তল, যেন প্রমাণ করতে এই ঘরের ভেতরের প্রতিটি জীব ও জড়বস্তু অপেক্ষা তার ক্ষমতা অধিক।

এক জন অচেতন মানুষ ধীরে ধীরে চেতনা ফিরে পাচ্ছে। তার মুখ থেকে গোঙ্গানির শব্দ শুনেই বোধহয় অপরজনও সজাগ হয়ে উঠল। দুজনের কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুনতে পেল অদৃশ্য কেউ একজন বলছে, “স্বাগতম! স্বাগতম! মৃত্যুপথ খেলায় অংশ নেওয়ায় আপনাদের জানাই অশেষ ধন্যবাদ”।
শব্দের উৎসের খোঁজে ঘরের চারিদিকে উদভ্রান্তের মত দৃষ্টি বোলাল দুজনেই। ঘরের এক কোনে ছোট একটা সাউন্ড স্পিকার নজরে এলো। দুজনের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটি বলে উঠল, “কে আপনি? কি চান? কেন ধরে এনেছেন আমাকে?”
অচেনা সেই কণ্ঠ বলল, “ধীরে মাহতাব সাহেব! ধীরে! সবই বলব আপনাদের। একটু সুস্থির হয়ে বসুন”।

সুস্থির হওয়ার উপায় নেই মাহতাবের। কপালের দুপাশে প্রচণ্ড রকমের ব্যথা অনুভব করছে। সম্মুখে বসে থাকা লোকটির দিকে নজর দিল। বয়সে ছেলেটা তার চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট হবে হয়ত। চোখে মুখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। কপালের একধার বেঢপ ভাবে ফুলে আছে। ঘটনার আকস্মিকতায় দুজনেই তারা স্বাভাবিক চিন্তা শক্তি হারিয়ে ফেলেছে!

অচেনা কণ্ঠ বলছে, “মাহতাব চৌধুরী এবং আরিফ হোসেন, আপনারা দুজনেই আমাদের এক লাইভ গেইমশো তে অংশ গ্রহণকারী। এই খেলার নাম মৃত্যুপথ, চলছে সিজন সেভেন। আমি আপনাদের হোস্ট, সপ্তম মৃত্যুপথ পরিচালনাকারী। আমাকে আপনারা চাইলে মৃত্যুদূত বলেও ডাকতে পারেন ...”
দুজনকে দেখলে মনে হবে তারা বোধহয় একটা ঘোরের মধ্যে আছে। ব্যাপারটা যে স্বপ্ন নয়, সত্যিই ঘটছে সেটা এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না কেউ।

অচেনা কণ্ঠ কিন্তু থেমে নেই, “... আমাদের গেমের স্লোগান হচ্ছে- কিল অর বি কিল্ড। খেলায় রয়েছে মোট পাঁচটি রাউন্ড। প্রতি রাউন্ডে আপনার সামনে দুটো অপশন খোলা থাকবে। আপনাকে হয় একজন মানুষকে হত্যা করতে হবে, নইলে আত্মহত্যা করতে হবে। আত্মহত্যা করলে আপনি খুব সহজেই এই খেলা থেকে মুক্তি পেয়ে যাবেন। আর যদি হত্যা করতে পারেন তাহলে আপনি পরের রাউন্ড খেলার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। এভাবে চার রাউন্ডে জয়লাভ করলে আপনাকে আমাদের মৃত্যুপথ খেলার সপ্তম সিজনের চূড়ান্ত বিজয়ী বলে ঘোষণা দেওয়া হবে এবং আপনার জন্য থাকবে বিশেষ পুরষ্কার!”

কণ্ঠের অস্থিরতাটুকু ঢেকে রাখতে ব্যর্থ হল আরিফ, “কিন্তু আ... আমাকে কেন এখানে ধরে আনা হয়েছে? আ... আমি তো এই খেলায় অংশ নিতে চাইনি!”
তার সাথে সুর মেলাল মাহতাব, “হ্যা! আমিও এই খেলা খেলতে চাইনি! আপনার কি অধিকার আছে আমাদেরকে জোর করে ধরে এনে খেলায় অংশ নিতে বাধ্য করার?”
“হা হা হা...” অট্টহাসির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কারো হাসির আওয়াজ এমন ভয়ংকর হতে পারে সেটা নিজ কানে না শুনলে বিশ্বাস করা যায়না। যেমন হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল তেমনি আচমকা থেমে গেল মৃত্যুদূতের হাসি। “আমাদের এই গেমে অংশ নিতে হলে একটি বিশেষ অপরাধ করতে করতে হয়। তবে শুধু অপরাধ করলেই হবেনা, আইনের ফাঁক গলে পালিয়ে আসতে হবে। আপনারা উভয়ই সেই কাজটি করে আসতে পেরেছেন সফলভাবে”।
“কি করেছি আমরা?”
“আপনাদের দুজনের সামনে দুটো পত্রিকার কাটা অংশ পড়ে আছে। খেয়াল করলে দেখবেন আপনাদের ডান হাত বেঁধে রাখা হয়নি। পত্রিকার খবরটি পড়ে দেখুন”।
দুজনেই যার যার সামনে ফেলে রাখা পত্রিকার কাটা অংশটুকু হাতে নিল।

আসুন দর্শক, আমরা প্রথমে আরিফের হাতে ধরে রাখা পত্রিকার খবরটিতে নজর দেই-

বন্ধুদের হাতে বন্ধু খুন

যশোরে বন্ধুদের ছুরির আঘাতে মারা গেলো শরিফুল ইসলাম শরিফ নামে আরেক বন্ধু। রোববার ছুরির আঘাতে মারাত্মক জখম হলে তাকে যশোর মেডিকেলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুপুর দেড়টার দিকে তার মৃত্যু হয়। নিহত শরিফ যশোর শিক্ষাবোর্ড মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণীর বাণিজ্য বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র।এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে কয়েকজনকে খুঁজছে পুলিশ।
স্থানীয় ও হাসপাতাল সূত্র জানায়, রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শরিফের বাড়ির সামনে তার বন্ধু জুয়েল, আরিফ ও নাজমুলের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে বন্ধুরা তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করলে শরিফ মারাত্মকভাবে আহত হয়। যশোর মেডিকেলে ভর্তির পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেলা দেড়টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
যশোর কোতোয়ালি থানার ওসি এমদাদুল হক শেখ জানান, প্রেমঘটিত কারণে বন্ধুদের ছুরির আঘাতে শরিফের মৃত্যু হয়েছে। তিনি আরো জানান, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে নাজমুল নামে একজনকে আটক করা হয়েছে। বাকিদের দোষ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততা খুঁজে না পেয়ে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে।


এবার আসুন দেখি মাহতাব কোন খবর পড়ছে-

বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্রেমিকের হাতে প্রেমিকা খুন

রাজধানীর শাহআলী থানাধীন মিরপুর-২ এলাকায় অবস্থিত বোটানিক্যাল গার্ডেনে ডেটিং করতে গিয়ে প্রেমিকাকে উড়না দিয়ে পেঁচিয়ে হত্যা করেছে প্রেমিক। অজ্ঞাত তরুণীর বয়স আনুমানিক ২৫ বছর বলে জানিয়েছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টার দিকে গার্ডেনের দর্শনার্থী ও নিরাপত্তারক্ষীদের দেয়া খবরের ভিত্তিতে ফুলবাগান থেকে শাহআলী থানা পুলিশ অজ্ঞাত ওই প্রেমিকার লাশ উদ্ধার করে। সুরতহাল রিপোর্ট শেষে ময়নাতদন্তের জন্য লাশটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছে।
শাহআলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সেলিমুজ্জামান নিউজ বিডি ডটনেটকে বলেন, বোটানিক্যাল গার্ডেনের ফলবাগানে পড়ে থাকাবস্থায় আমরা ওই তরুণীর মৃতদেহ উদ্ধার করি। নিহতের গলায় কালো দাগ এবং নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হওয়া অবস্থায় ছিল। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ওড়না দিয়ে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।
গার্ডেনের নিরাপত্তারক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে সন্দেহভাজন যুবককে শনাক্ত করে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানান ওসি। জানা গেছে, দুপুরের দিকে বোরকা পরিহিত এক তরুণী ও এক যুবক গার্ডেনে প্রবেশ করে। তাদের চালচলন ছিল প্রেমিক-প্রেমিকার মতো। ডেটিং করার জন্যই তারা ফুলবাগান এলাকায় অবস্থান করছিল। বিকালের দিকে তরুণীর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশ এসে উদ্ধার করে।


যার যার হাতের খবরটি পড়ে দুজনেই কিছু সময়ের জন্য চুপ করে থাকল। নীরবতা ভাঙল স্পীকারে ভেসে আসা মৃত্যুদূতের কণ্ঠস্বর। “এবার নিশ্চয়ই বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না সেই বিশেষ অপরাধটি কি!”
কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর একসময় আরিফ অস্ফুট কণ্ঠে বলল, “মিথ্যে কথা! এই কাজ আমি করিনি। শরিফকে আমি খুন করিনি”।
মৃত্যুদূতের অট্টহাসি শোনা গেল স্পীকারে। হাসতে হাসতেই বলল, “এই কথা আপনি পুলিশকে বলেছেন আরিফ। আমাদের কাছে মিথ্যা বলে কি লাভ? কোন কিছুই আমাদের অজানা নয়”।
“বিশ্বাস করুন শরিফকে আমি খুন করতে চাইনি। ব্যাপারটা ছিল এক্সিডেন্ট! সে জানত আমি লামিয়াকে ভালবাসি, তারপরও সে...” আর কিছু বলতে পারল না আরিফ। গলা ধরে এলো তার।
“আপনিও কি কিছু বলতে চান মাহতাব?”
“মেয়েটি আমার সাথে চিটিং করেছিল”। মাহতাবের কণ্ঠ থেকে ঘৃণা ঝরে পড়ল যেন! “আমার আগেও অনেক ছেলের সাথে সে প্রতারণা করেছে!”
“কোন কারণই তকে খুন করার পক্ষে যথেষ্ট নয় মাহতাব! একজন মানুষের জীবন মৃত্যু নিয়ে আপনি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, যতক্ষণ না সে অন্য কাউকে হত্যা করার মত জঘন্য অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে”।

আরও কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। দেয়াল ঘড়িটা নষ্ট না হলে এখন তার সেকেন্ডের কাটা ঘোরার সময় টিক টিক শব্দ স্পষ্ট শোনা যেত!

মৃত্যুদূত ইচ্ছাকৃত কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিল। “তাহলে শুরু করা যাক আমাদের মৃত্যুপথ খেলার প্রথম রাউন্ড! টেবিলের ওপর একটা পিস্তল রাখা আছে, সম্পূর্ণ ম্যাগাজিন গুলি ভরা। সেফটি ক্যাচ অফ করা আছে। কোন ঝামেলা নেই। আপনাদের দুজনের মধ্যে যে আগে পিস্তলটি তুলে নিয়ে অপরজনকে লক্ষ করে গুলি করতে পারবে সে দ্বিতীয় রাউন্ডে উত্তীর্ণ হবে। আপনাদের উভয়ের ডান পায়ে একটা করে অ্যাঙ্কলেট লাগানো আছে। এটা একই সাথে একটা মুভমেন্ট ট্রাকার, লিসেনিং ডিভাইস, মাইক্রো ক্যামেরা এবং একটা সেলফ ডিজপসেবল বোমা। আপনার প্রত্যেকটি মুভমেন্ট পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে সেট করা টাইম অনুযায়ী এখন থেকে ঠিক ত্রিশ মিনিটের মধ্যে বোমাটি বিস্ফোরিত হবে। তাই যা করার ত্রিশ মিনিটের আগেই করতে হবে। আপনাদের সময় শুরু হচ্ছে এখন...

“রাউন্ড ওয়ান”

সামনে বসে থাকা ছেলেটির দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে মাহতাব। ইতিমধ্যে সে একটু ধাতস্থ হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ছেলেটিকে দেখে মনে হচ্ছে সে এখনও ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পুরো ব্যাপারটি যে স্বপ্ন নয়, মানুষের মরণশীলতার নগ্ন বাস্তব সেটা এখনও তার মস্তিষ্ক গ্রহণ করতে পারেনি। এক দৃষ্টিতে টেবিলে পড়ে থাকা পিস্তলটার দিকে তাকিয়ে আছে...

“আপনাদের জন্য বরাদ্দ সময়ের পাঁচ মিনিট ইতিমধ্যে পেড়িয়ে গেছে”। স্পীকারে ভেসে এলো মৃত্যুদূতের কণ্ঠস্বর।

মাহতাব যুক্তি দিয়ে পরিস্থিতি বিচার করার চেষ্টা করছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে কোন উদ্ভট পাগলের খপ্পরে পড়েছে। কিন্তু বোটানিক্যাল গার্ডেনে সেদিন যা ঘটেছিল তা কাকপক্ষীও টের পাওয়ার কথা নয়! একজন উন্মাদ তা জানবে কি করে? তারমানে এই আয়োজনের পিছনে কেবল একজন মানুষ নয়! তারা আটঘাট বেধেই নেমেছে। ওদের কথামত কাজ না করলে অদৃষ্টের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই...

“পনের মিনিট শেষ! বরাদ্দকৃত সময়ের মাঝ পথে আছি আমরা। আর একবার আপনাদের মনে করিয়ে দেই। কোন অবস্থাতেই অতিরিক্ত সময় দেয়া হবেনা। শুধুমাত্র একজন অপরজনকে খুন করলেই আমরা অ্যাঙ্কলেটের ভেতরকার বিস্ফোরকটির টাইম রিসেট করে দেব। তাই বলছি- ভাবনা চিন্তা সংক্ষিপ্ত করুন। শেষে কিন্তু দুজনেই বোমা ফেটে মারা পড়বেন। আমরা চাইনা আমাদের মৃত্যুপথ খেলার একটি সিজন গোড়াতেই পন্ড হয়ে যাক। আমরা জমজমাট উত্তেজনায় ভরপুর পাঁচটি রাউন্ডের অপেক্ষায় আছি”।

এক হাত বাড়িয়ে পিস্তলটা তুলে নিলেই হল। ট্রিগার টিপতে আর কতক্ষণ লাগবে? মাত্র দু সেকেন্ডের ব্যাপার! ব্যাস, খেল খতম! খুন আগেও করেছে মাহতাব। কিন্তু সে খুনের পিছনে একটা বিশ্বাস কাজ করেছিল। সমস্ত অস্তিত্ব-জুড়ে একটা প্রতিশোধ স্পৃহা স্পষ্টরুপ ধারণ করেছিল। কিন্তু এখন কোন বিশ্বাস নিয়ে খুন করবে সে? সামনে বসে থাকা ইনোসেন্ট চেহারার ছেলেটাকে খুন করার চাইতে তাই বাঁচার অন্য উপায় খুঁজে বের করা অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে...

“পঁচিশ মিনিট সম্পূর্ণ হয়েছে। আর মাত্র পাঁচ মিনিট সময় আছে হাতে। এর মধ্যে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব সম্পাদন করতে ব্যর্থ হলে উভয়েই মারা পড়বেন। নিজেকে বাঁচাতে হলে অপরের নিয়তিতে মৃত্যু লিখে দেওয়া ছাড়া আপনাদের সামনে পথ খোলা নেই”।

হঠাৎ আরিফ ঝট করে হাত বাড়িয়ে পিস্তল তুলে নিল। প্রমাদ গুনল মাহতাব। ভেবেছিল শেষ মুহূর্ত অপেক্ষা করে দেখবে অন্য কোন উপায় খুঁজে পাওয়া যায় কিনা! কিন্তু আরিফ ততক্ষণ অপেক্ষা করে থাকতে রাজি নয়। সে মাহতাবের বুক বরাবর পিস্তলের নিশানা করল। মাহতাব লক্ষ করল আরিফের চোখে মুখে দ্বিধা। কয়েক মুহূর্ত নীরবে কাটল। কিন্তু বিবেকের সাথে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত আর পারল না আরিফ। পিস্তল নামিয়ে রেখে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। মেনে নিয়েছে ভাগ্যকে। এই ভাবে যদি তার মৃত্যু লেখা থাকে, তবে তাই হোক....

“আর মাত্র দুই মিনিট বাকি। সময় ফুরোবার পথে। আমরা এখনও আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয়ীকে খুঁজে পাইনি। এটা খুবই দুঃখজনক যে চমৎকার একটি খেলা খেলোয়াড়দের ভুলে শুরুতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে!”

মাহতাব হাত বাড়াল। অন্য একটা উপায় খুঁজে পেয়েছে। পিস্তলটা নিজের মাথায় ঠেকাল সে, ট্রিগারে আঙ্গুল রাখল। বিনা কারণে একজন মানুষকে খুন করা সম্ভব নয় তার পক্ষে। আবার বোমায় উড়ে গিয়ে জঘন্য ধরনের মৃত্যুও সহ্য হবেনা। তারচেয়ে বরং এটাই ভাল! ট্রিগার টেনে দিলে দু সেকেন্ডের জন্য জীব জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যথা অনুভূত হবে। তারপর সব শেষ! শুরু হবে অনুভূতিহীন এক বিশাল শুন্যতার জগত...

আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড। কয়েকবার ট্রিগার টিপতে গিয়েও থেমে গেছে মাহতাব। তার ধারনা ভুল ছিল! কাউকে খুন করার চাইতে আত্মহত্যা করা অধিক কঠিন। আর হয়ত পাঁচ সেকেন্ড আছে! ঝট করে এলো সিদ্ধান্তের পরিবর্তন। পিস্তল নিশানা করে ট্রিগার টেনে দিল মাহতাব। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বিকারহীন ভঙ্গিতে পড়ে ছিল আরিফ। সে হয়ত জানত না ক্লোজ রেঞ্জে একটা পয়েন্ট থ্রি টু ক্যালিবারের বুলেট শটগানের বুলেটের তুলনায় কোন অংশে কম নয়! মাথার খুলির একপাশ প্রায় উড়ে গেল তার। ছিটকে বেরিয়ে এলো মগজ! যেন বলতে চাইছে- জঘন্য এক কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত নিশ্চিত হল।

“রাউন্ড টু”

ঝিনাইদহ সদর থেকে কুমারখালি উপজেলা পর্যন্ত যাত্রাপথে অন্তত দুই বার ট্রাক থামাতে বাধ্য হয় হোসেন মিয়া। সাধারণত খুব সকালে দুইটা গরম ভাজা পরোটা আর এক কাঁপ চা খেয়েই রওনা দেয় সে। মাথার ওপর সূর্য যখন দ্বিপ্রহরের ঘোষণা দেয়, তখন সস্তাদরের একটা হোটেল দেখে ট্রাক থামিয়ে নেমে পড়ে। ভর্তা-ভাজি-মাছ দিয়ে দু প্লেট ভাত পেটে চালান করেই আমার রওনা। তবে বিকেলের নরম রোদের ছোঁয়া লাগার শরীরে লাগার সময়টাতে আরও একবার থামার প্রয়োজন হয় তার। এইবার থামার জন্য নির্দিষ্ট কোন যায়গা বাছতে হয়না। প্রকৃতির ডাক তো আর বলে কয়ে আসেনা! বড় কোন রেস্টুরেন্ট, ক্লিনিক কিংবা মসজিদে চোখে পড়তেই ট্রাক থামিয়ে নেমে পড়ে হোসেন মিয়া। কাজ সেরে এসে আবার শুরু হয় যাত্রা।

দীর্ঘ দশ বছর যাবত এই রুটিন মেনে দক্ষিণে ঝিনাইদহ থেকে উত্তরে কুমারখালি পর্যন্ত মালামাল আনা নেওয়ার কাজে অভ্যস্ত হোসেন মিয়া। আগে মহাজনের ট্রাক চালাত, পয়সা জমিয়ে এখন নিজেই ট্রাক কিনেছে। তবে আজই প্রথম তার রুটিনে একটু পরিবর্তন লক্ষণীয়। আজ যে সাহেবের মালামাল নিয়ে যাচ্ছে লোকটা সম্ভবত পয়সাওয়ালা পাবলিক। আজ দুপুরে বড় রেস্টুরেন্টে নানা পদের চেনা অচেনা মুখ-রোচক খাবার পেট ভরে খাওয়ার সুযোগ মিলেছে। শাহী খানা শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে আয়েশি ভঙ্গিতে রওনা দিয়েছে আবার। তবে সাহেব লোকটা শুধু টাকার দিক দিয়ে বড়লোক তাই নয়, মনের দিক থেকেও লোকটা বড়। সারা পথ ট্রাকে তার পাশে বসে অনর্গল বক বক করছে। এমন ভাল মানুষের দেখা কালে ভদ্রে মিলে, সচরাচর তো কখনই নয়। ট্রাক জুড়ে কয়েক বস্তা ভর্তি সাদা কাগজ, এত কাগজ নিয়ে করবে কি লোকটা? সম্ভবত প্রিন্টিং এর ব্যবসা আছে।

“হোসেন মিয়া ট্রাকটা একটু সাইড করেন দেখি”!
হোসেন মিয়া তাকিয়ে দেখল আশে পাশে দোকান পাট, বাড়ি ঘর কিছুই নেই। উঁচু রাস্তার এক ধারে বড় বড় গাছ পালা, অন্যপাশে ফসলের ক্ষেত। সে জিজ্ঞেস করল, “এই খানে নামবেন ক্যান স্যার? বিরান অঞ্চল! আশে পাশে তো কিছু নাই”।
সেই জন্যই তো এখানে নামছি হোসেন মিয়া! লোকটা দাঁত বের করে হাসল। ডানহাতের কড়ে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, “ছোট কাজ ডেকেছে”!
হোসেন আলী হি হি শব্দে চাঁপা হাসি হেসে বলল, “ঠিক আছে স্যার, নামেন! কোন সমস্যা নাই”!
ঘন ঝোপের পাশ ঘেঁষে ট্রাক থামাল হোসেন মিয়া। লোকটা দরজা খুলে নেমে গেল।
“আপনিও নেমে পড়ুন হোসেন মিয়া। দেখেন কি চমৎকার বাতাস লাগছে!”
সাহেব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুকুর স্টাইলে ছোট কাজ সাড়ছে। হোসেন মিয়া প্রশ্ন করল, “স্যার আপনের নামটা তো এখনও জানা হইল না!”
“আমার নাম মাহতাব চৌধুরী”।
“বাহ! ভাল মানুষের ভাল নাম”!
ছোটকাজ শেষে প্যান্টের জিপার আটকাচ্ছে মাহতাব। হোসেন মিয়া দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে উঠতে উদ্যত হল। মাহতাব বলল, “এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন হোসেন মিয়া? বউ তাড়াতাড়ি ফিরতে বলে দিয়েছে নাকি?”
হোসেন আলী দাঁত বের করে বলল, “না, স্যার! বেলা থাকতে থাকতে পৌঁছাইতে চাইতেছি। রাইত হলে মেলা সমস্যা, যায়গা বেশি সুবিধার না”।
“তা তো বুঝলাম। কিন্তু তাড়াহুড়োর ফল কখনও ভাল হয়না সেটা জানেন তো?”
“জী স্যার, জানি!”
মাহতাব পকেট থেকে একটা পেপারের ছেঁড়া অংশ বের করল। “হোসেন মিয়া বাংলা পড়তে পারেন তো?”
“জী স্যার। ক্লাস ফাইভ পাস দিছিলাম”।
“দেখেন তো কি লেখা আছে এখানে”। পেপার কাটিংটা হোসেন মিয়ার হাতে ধরিয়ে দিল মাহতাব।

হোসেন মিয়া কাগজটা হাতে নিয়া দু লাইনের বেশি পড়তে পারল না। তার সমস্ত মুখ ফ্যাকাসে রূপ ধারণ করেছে। হোসেন মিয়া পড়েনি বলে কিন্তু আমরা তো দর্শকদের বঞ্চিত করতে পারিনা! চলুন হোসেন মিয়ার হাতে ধরা পেপার কাটিং এর উপর একটু নজর বুলিয়ে নেই....

“শৈলকুপায় ট্রাক চাপায় ছাত্র নিহত”

ঝিনাইদহের শৈলকুপায় ট্রাক চাপায় ইমন হোসেন (১৩) নামের এক মাদ্রাসা ছাত্র নিহত হয়েছে। রবিবার সকাল ৮টায় কুষ্টিয়া সড়কের সতেরো মাইল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত ইমন শৈলকুপা উপজেলার সাধুখালি গ্রামের মসিউর রহমান বাবুর ছেলে। সে বড়দাহ দাখিল মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র।
শৈলকুপা থানার ওসি আনোয়ার জানান, ঝিনাইদহ থেকে আলুবোঝাই একটি ট্রাক বিপরীত দিক থেকে আসা মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই ইমন নিহত ও তার বাবা গুরুতর আহত হয়। উল্লেখ্য যে প্রত্যক্ষদর্শী না থাকায় ঘটনায় দায়ী ট্রাক ও ড্রাইভারকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।


“কি ব্যাপার হোসেন মিয়া? পড়ে দেখুন কি লেখা আছে!”
“কে আপনে?” হোসেন মিয়ার কণ্ঠস্বর কেঁপে গেল।
মাহতাব ঠোঁটের কোনে হাসি দেখা গেল। “আমি মৃত্যু পথের যাত্রী হোসেন মিয়া, ঠিক আপনার মত”।
হোসেন মিয়া দ্রুত চিন্তা করার চেষ্টা করছে, কিন্তু চিন্তাগুলো সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই সে খেয়াল করল যায়গাটা শৈলকূপা, কাছেই সাধুখালি গ্রাম। এখানেই কোথাও বছর তিনেক আগে সেই ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটেছিল।
“কি চিন্তা করছেন হোসেন মিয়া”?
অবশেষে হোসেন মিয়া ঠিকঠাক চিন্তা করতে সমর্থ হল। দ্রুত ট্রাকে উঠে পালাতে হবে!
“ভুলেও পালানোর কথা ভাববেন না! অনেক পালিয়েছেন, আর কত? নিয়তির কাছে এবার নতি স্বীকার করুন”!
মাহতাবের হাতে বেরিয়ে এসেছে চকচকে সাইলেন্সার লাগানো ওয়ালথার পিপিকে, মৃত্যু বর্ষণের জন্য প্রস্তুত! পিস্তলটা দেখে আতংকেড় ঢেউ নামল হোসেন মিয়ার শিরদাঁড়া বেয়ে। একটা ঢোক গিলে ফেলল অজান্তেই। “বিশ্বাস করেন স্যার! আমার কোন দোষ ছিলনা। ঐদিন ট্রাকের ব্রেকটা একটু ঝামেলা করতাছিল”!
“হাসালেন হোসেন মিয়া! হাসালেন”। বিদ্রুপের সুরে বলল মাহতাব। “হাসিখুশি বাপ ছেলে মোটর সাইকেলে চেপে আসছিল! আপনি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সোজা চাকা উঠিয়ে দিলেন তাদের উপর! আপনি জানেন যে আঘাতের পরও ছেলেটা বেঁচে ছিল! সময়মত হাসপাতালে নিলে বাঁচানো যেত। কাপুরুষের মত পালিয়ে না গিয়ে বাপ ছেলেকে ট্রাকে তুলে একটা হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে সরে আসতেন! কেউ ঘুনাক্ষরেও জানত না কাজটা কে করেছে”!
“আমার মাথা কাজ করে নাই স্যার! আমারে মাফ কইরা দেন”।
“মাফ করে দিতে গেলে যে নিজেকে হার মানতে হয়! অদৃষ্ট আমাদের নিয়ে খেলছে হোসেন মিয়া। এই খেলায় আমি পরাজিত হতে চাইনা”! হোসেন মিয়ার বুক বরাবর নিশানা করল মাহতাব। গুলি করার অভিজ্ঞতা তার নেই, স্বভাবতই হাতের টিপ ভালনা। কিন্তু এত কাছ থেকে টার্গেটে গুলি লাগাতে হাতের টিপ ভাল হওয়ার কোন প্রয়োজনীয়তা সে দেখছে না। খেলাটা সে উপভোগ করছে এখন!

সেই রাতে হোসেন মিয়ার মৃতদেহ আবিষ্কার করল গ্রামের মানুষজন। বুকের বা পাশটাতে একটা গুলির চিহ্ন! এক ট্রাক ভর্তি কাগজ নিয়ে জনবসতি থেকে দূরে একজন ট্রাক ড্রাইভার গুলি খেয়ে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকার পেছনে বিরাট কোন রহস্য থাকার সম্ভাবনা কারো মাথায় খেলল না। পুলিশ একটা দায়সারা টাইপের তদন্ত শেষে ডাকাতের হাতে খুন বলে রিপোর্ট করে দিল। দৈনিক পত্রিকার পাতায়ও ছোট্ট করে একটা নিউজ দেখা গেল। নিউজের হেডলাইন- “শৈলকূপায় দুর্বৃত্তদের হাতে ট্রাক ড্রাইভার খুন”।

“রাউন্ড থ্রি”

ছোট ছোট পদক্ষেপে নতুন ভাড়াটিয়ার রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল পারভীন। আশে পাশে নজর বুলিয়ে দেখে নিল কেউ লক্ষ করছে কিনা। তারপর দরজায় নক করল। ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, “কে?”
“মাহতাব ভাই, আমি পারভীন। ভীতরে আসতে পারি?”
“তোমার বাড়ি তোমার ঘর না আসতে পারার তো কোন কারণ দেখিনা!”

দরজা একটু ফাক করে ভেতরে ঢুকে পড়ল পারভীন। মাহতাব চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছিল। তার দিকে তাকিয়ে চমৎকার একটা হাসি দিল। সেই হাসিতে পারভীনের ভেতরকার পৃথিবীতে একটা ছোট খাট ঝড় বয়ে গেল। চোখ নামিয়ে নিল সে, ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠল অভিসারে বের হওয়া তরুণীর লাজুক হাসি। খাটের কিনারায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল, “কি করেন মাহতাব ভাই?”
“পুরনো পত্রিকা পড়ি”।
“পুরান পত্রিকা পইড়া কি লাভ? সব খবর তো পুরান হয়ে গেছে”!
“কিছু খবর কখনও পুরনো হয়না পারভীন। অদৃষ্টের নিয়ম তাকে পুরনো হতে দেয়না”।
“আপনার কথা বেশির ভাগই বুঝিনা আমি কিন্তু শুনতে ভাল লাগে”।
মাহতাব নীরবে আবার সেই হাসি উপহার দিল তাকে।
পারভীন নিজের গলায় দামী নেকলেসটাতে হাত বুলচ্ছে। গতকাল এটা মাহতাব তাকে গিফট করেছে। বলল, “কেমন লাগতেছে আমারে?”
“চমৎকার! অপ্সরীর মত লাগছে তোমাকে!” বলে পত্রিকা চেয়ারে রেখে উঠল মাহতাব। পারভীনের কাছে এসে বসল। “কিন্তু পারফেক্ট মনে হচ্ছেনা। শাড়ির কালারটা আরও একটু ডিপ হলে মনে হয় বেশি ভাল লাগত”।
“হ, আমারও মনে হইতাছিল আর একটু ডিপ কালারের শাড়ি হইলে ভাল হইত”। কথাটা মিথ্যা বলেছে পারভীন। তার মনে হয়েছিল হয়ত মাহতাবের চোখে হালকা রঙের শাড়ি ভাল লাগবে। “কিন্তু কি করমু? ডিপ কালারের শাড়ি নাই তো!”
“এই কথা আমাকে আগে বলবে না? আহা! এমন সুন্দর একটা অবয়ব সামান্য ডিপ কালারের শাড়ির অভাবে প্রস্ফুটিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেনা! তাই কি হয়? আমি কালই ব্যবস্থা নিচ্ছি”।
“মাহতাব ভাই আপনি এইগুলা কেন করেন আমার জন্য?”
“তোমাকে ভাল লাগে তাই”। দ্বিধাহীন উত্তর মাহতাবের।
“সত্যি বলতেছেন?”
“অমন সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে কেউ কি মিথ্যা বলতে পারে?” পারভীনের মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহতাব।
“আপনার মুখে কিচ্ছু আটকায় না!”

তারপর কিছুক্ষণ মধুর নিরবতা। ঘরের ভেতর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকা দুজন নর নারীর নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ ব্যতীত অন্য কোন শব্দ নেই।
পারভীন নিরবতা ভাঙল, “আচ্ছা মাহতাব ভাই, একটা প্রশ্ন করি?”
“যা খুশি প্রশ্ন কর, অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন নেই। তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে যদি সমস্ত জীবন নিঃশেষ হয়ে যায়, আমি তাতেও দ্বিধান্বিত হবোনা”।
“আপনার তো অনেক টাকা পয়সা আছে। ভাল চাকরী করেন। ভাল যায়গায় গিয়া থাকার ক্ষমতা আছে। তাইলে আপনি ক্যান এই খানে আইসা বাসা ভাড়া নিলেন?”
“তোমার জন্য”।
“ধুর আপনে মিথ্যা বলতাছেন। আমারে পটানোর জন্য অনেক মিথ্যা বলছেন। আমার সাথে তো আপনার এইখানে আইসা পরিচয়”।
“মিথ্যা না! আমার এখানে আসার কারণ তুমিই। তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম একটা মার্কেটে কেনা কাটা করার সময়। তারপর থেকে আমার রাতের ঘুম হারাম! মাথায় শুধু একটাই চিন্তা কাজ করত- যেমন করেই হোক তোমার সান্নিধ্যে আসতে হবে। তারপর জানলাম তুমি এই বাড়ির মালিক। এখানে একটা রুম খালি আছে শুনে তাই আর দেরি করিনি”।
“কিন্তু আমি তো বিবাহিত...”
“বিবাহিত এবং অসুখী”। কথাটা সম্পূর্ণ করে দিল মাহতাব। “আমি জানি স্বামীর সাথে তোমার বনিবনা হচ্ছেনা। তোমার টাকায় খেয়ে পড়ে বজ্জাত লোকটা তোমার উপরে মাতব্বরি করে। তোমার মত সুন্দরী স্ত্রীকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়ার যোগ্যতা তার নেই”।
“ঠিক বলছেন। আসলামরে বিয়ের আগে যেমন মনে করছিলাম সে তেমন না”। মনের আক্ষেপ কণ্ঠে ফুটে উঠল পারভীনের। “আমার পয়সা উড়াইয়া সে মদ গাঞ্জা খাইয়া আসে। আমি কিছু বলতে গেলেই যা তা ব্যাবহার করে”।
“থাক। কষ্ট পেওনা। আমি চলে এসেছি। কারো রাগ, ঘৃণা কিংবা হিংসা আর তোমায় স্পর্শ করতে পারবে না”। এক হাত বাড়িয়ে পারভীনের গাল স্পর্শ করল মাহতাব। একদম কাছে চলে এসেছে। তরল কণ্ঠে বলল, “তোমার উপরে সমস্ত অধিকার এখন থেকে একমাত্র আমার”।

মাহতাবের হাতের ছোঁয়ায় পারভীনের সমস্ত শরীরে শিহরন জাগাল। সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, “কিন্তু আমি তো অশিক্ষিত মেয়েমানুষ, আপনি জ্ঞানী গুনি মানুষ। আপনার সাথে আমার মেলেনা”।
“কে বলেছে মিলেনা? তোমার আর আমার পথ একই। নিয়তি আমাদের এক সূত্রে গেঁথে দিয়েছে পারভীন”।

মাহতাব আরও কাছে চলে এসেছে। পারভীনের গলার কাছটায় তার গরম নিঃশ্বাসের ছোঁয়া লাগছে। একবার মাহতাবের দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল সে। পুরুষ মানুষের ঐ দৃষ্টির কি অর্থ তা পারভীনের অজানা নয়। মাহতাবের ছোঁয়ায় কাছে পাওয়ার আহবান। তার নারী সত্তাও জেগে উঠছে, সাড়া দিচ্ছে সেই ডাকে। সমস্ত শরীরে গ্রহণ করতে চাইছে পুরুষের আস্বাদ। দুজন পরস্পরের একদম কাছে চলে এসেছে। দুজোড়া ঠোঁটের মাঝে কেবল একচুল দূরত্ব।

আচমকা পিছিয়ে গেল মাহতাব। পারভীনের নাক মুখ লক্ষ করে ডানহাতে প্রচণ্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হওয়ার সুযোগ পেলনা পারভীন। ছিটকে গিয়ে দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়েই মাথা ঘুরে উঠল। হাঁটুর নিচে বল পাচ্ছে না সে, পরে যাচ্ছে, প্রানপনে কিছু একটা ধরে তাল সামলানোর চেষ্টা করল। মাহতাব দ্রুত এগিয়ে এসে ধরে ফেলল তাকে। মুখের ওপর শক্ত টেপ লাগিয়ে দিল যেন চিৎকার করতে না পারে। তারপর তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসিয়ে
 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on February 15, 2014 19:28

October 26, 2013

জননী

বদি তার ওস্তাদকে খুব সম্মান করে। কিন্তু ওস্তাদের এই নতুন ধান্দাটা তার ভাল লাগছে না। আগে টুক-টাক ছিনতাই আর চুরি চামারি করত তারা, সেটাই ভাল ছিল। কিন্তু কিডন্যাপিং এর মত বিপদজনক একটা কাজের সাথে সে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না। ওপরে যতই সাহস দেখাক না কেন, বদি আসলে অনেকটা ভীতু প্রকৃতির মানুষ।



তার ওস্তাদের নাম পাগলা মজিদ। নামের আগে “পাগলা” শব্দটা অবশ্য কিছুদিন আগে যোগ হয়েছে। আজকাল এমন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে যে, সন্ত্রাসীদের নামের আগে একটা ভয়ংকর বিশেষণ না থাকলে মানুষ ভয় পায়না। তাই ছিনতাই থেকে একলাফে কিডন্যাপিংএর ধান্দা শুরু করায় মজিদ এখন নিজেকে “পাগলা মজিদ” হিসেবে পরিচয় দেয়। তাছাড়া ইদানিং দুই চারজন রাজনৈতিক নেতার সাথে মজিদের খাতির হয়েছে। তাদের হয়ে টুক টাক কাজ করায় মজিদের নামটা চারিদিকে ভালই ছড়িয়েছে। পাগলা মজিদ নামটা শুনলেই এখন অনেকে ভয় পায়!

বদি আর আলামিন ছোটবেলায় টোকাই ছিল। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মানুষের ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র, কাগজ আর প্লাস্টিকের বোতল টুকিয়ে বস্তায় ভরে বিক্রি করে যা পেত তা দিয়ে কোন মতে পেট চলে যেত। মজিদ তাদেরকে সেই অবস্থা থেকে তুলে এনেছে। আশ্রয় দিয়েছে, দুবেলা পেট ভরে খাওয়ার সুযোগ দিয়েছে। তাই ওস্তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস হয়না তার। এর কারন কি? শুধু সম্মান নাকি ভয়? এই প্রশ্নের উত্তর বদির জানা নেই।



আজ সকাল থেকে বদি লক্ষ করছে তার ওস্তাদ একটা টুলের ওপর চুপ চাপ বসে আছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা বিষয় নিয়ে চিন্তিত। অন্যান্য সময় এতক্ষনে সে বলে উঠত, “বদি একটা গান ধরতো! ঐ যে আমার গায়ে যত দুঃখ সয়- ঐ গানটা একটু গাইয়া শুনা”। অথবা আলামিনকে বলত, “আলামিন, একটা জোকস বল দেখি। ঐযে মাস্টার আর ছাত্রের একটা জোকস আছে না? ঐটা বল”! কিন্তু আজ তার ওস্তাদ একদম চুপ, মুখে কোন কথা নেই।

বদি একটু সাহস সঞ্চয় করে প্রশ্ন করে বসল, “বড়ভাই। আপনের কি মন খারাপ?”

মজিল কোন জবাব দেয়না।

“ও বড়ভাই! কিছু কন না ক্যান?”

মজিদ এবারও কোন জবাব দিলনা। উলটো গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল, “তোরে যে একটা কাম দিছিলাম, ঐটা ঠিকঠাক মত করসস তো?”

“জী ওস্তাদ। কালকে সারাদিন ঐ মহিলার ওপর নজর রাখছি”।

“কি মনে হয়? পুলিশের লগে যোগাযোগ করব?”

“না মনে হয়। মহিলা মারাত্মক ভয় পাইছে। একটাই পোলা তার, পুলিশের লগে যোগাযোগ করার রিস্ক লইব না”।

“হুম, না করলেই ভাল। আর করলেও সমস্যা নাই, নেতার লগে কথা বইলা রাখমু”। মজিদ একমুহূর্ত চুপ করে থাকে, তারপর আবার বলে, “এখন একটা কাজ কর। দোকান থেইকা আমার নাম কইয়া কলা আর পাউরুটি লইয়া আয়। পোলাটারে খাইতে দে, সকাল থেইকা খাওন দেওয়া হয় নাই”।

বদি সাথে সাথে গেলনা। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।

“কি হইল? কিছু কবি নাকি?”

বদি ভয়ে ভয়ে বলল, “একটা আবদার ছিল, বড়ভাই”।

“কি?”

“মহিলা প্রাইমারি স্কুলের মাষ্টার। স্বামী মারা গেছে অনেক বছর আগে। দুইটা পোলা মাইয়া লইয়া অনেক কষ্ট কইরা চলে। ৫০ লাখ টাকা সে কই থেইকা জোগাড় করব?”

“সেইটা আমাগো মাথা ব্যাথা না। আমরা আমাগো টাকা পাইলেই খুশি। কই থেইকা টেকা আইব সেইটা ঐ মহিলার মাথা ব্যাথা। তোর এইটা নিয়া চিন্তা করনের কাম নাই”।

“বড়ভাই, মুক্তিপনের টাকাটা ৫০ লাখ থেইকা কমাইয়া ১০ লাখ করন যায়না?”

মজিদ ব্যাঙ্গ করার ঢঙয়ে বলল, “তোর এত দরদ উথলায় উঠল কেন মহিলার লেইগা?”

“বড়ভাই, কিডন্যাপ করলে বড়লোকের পোলাপাইন কিডন্যাপ করন দরকার। হেরা যত টেকা চাই, তাই দিতে পারব। খামাখা গরীব মানুষের দুঃখ বাড়াইয়া লাভ কি?”

মজিদ কয়েক সেকেন্ড ভাবল, তারপর শান্ত গলায় বলল, “বড়লোকের নিজের পোলা মাইয়ার প্রতি মায়া কম থাকে, ওগো পোলাপাইন ধইরা আনলে ওরা পুলিশে যোগাযোগ করব, সন্তান বাঁচল কি মরল সেই খবর নাই। কিন্তু গরীবের তো সন্তান ছাড়া কিছুই নাই, ওরা নিজের সন্তানরে বাঁচানের জন্য জান দিতেও রাজি থাকে। শুন, এই লাইনে দুই চার পয়সা ধান্দা করার জন্য শুধু শক্তি থাকলে চলেনা, লগে বুদ্ধিও থাকা লাগে, বুঝছস?”

বদি হয়ত আরও কিছু বলত, কিন্তু মজিদ তাকে থামিয়ে দিল, “শুন বদি। তোরে আমি আগেও কইছি এই লাইনে কাজ করতে চাইলে এইসব চিন্তা বাদ দেওয়া লাগব। মনের ভিতরে মায়া দয়া থাকলে এই লাইনে উপরে উঠতে পারবি না। আজকে যা কওয়ার কইছস। সামনে যদি আর কোনদিন এই সব মায়া দয়ার কথা তুলস, তোরে বাইর কইরা দেওয়া ছাড়া আমার কোন গতি থাকব না বদি। কথাটা মাথায় রাখিস”।

বদি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।

মজিদ এবার গলার স্বর একটু নরম করে বলল, “শুন বদি। এই দুনিয়াতে বাচতে গেলে আর একজনরে মাইরা তোর বাঁচন লাগব। তুই যদি পেট ভইরা খাইতে চাস তাইলে আর একজনরে অভুক্ত রাখতে হইব”।



বদির ইচ্ছে হল বলে যে, “একজনরে অভুক্ত রাইখা পেট ভইরা খাওয়ার কি দরকার? একজনের খাবার দুই জনে ভাগ কইরা নিলে তো দু জনের পেটেই কিছু যায়!” কিন্তু কথাটা বলার সাহস তার হলনা! মাথা নিচু করে ওস্তাদের সামনে থেকে সরে গেল।



***



শাহিন গত তিনদিন যাবত যে ঘরটাতে অবস্থান করছে সেটা মাঝারি আকৃতির। ঘরের ভেতর আসবাব বলতে ছোট্ট লোহার খাট আর একটা আলমারি। শাহিনের একটা পা খাটের পায়ের সাথে শিকল দিয়ে বাঁধা। অনেক চেষ্টা করে দেখেছে শাহিন, তার পক্ষে নিজ চেষ্টায় এই শিকল থেকে মুক্তি পাওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। ঘরটায় একটা জানালা আছে, সব সময় বন্ধ করে রাখা হয়। জানালার একটা কাঁচ ভাঙা, দিনের বেলা সেই ফাক গলে খুব সামান্য একটু আলো আসে। ঘরের ভেতর অল্প পাওয়ারের একটা বাল্ব আছে। রাতের বেলা সেই বাল্বের আলোতে ঘরের ভেতরে এক আধিভৌতিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। দেয়ালগুলোকে দেখলে মনে হয় যেন দগদগে পচন ধরা ঘা হয়েছে! যায়গায় যায়গায় প্লাস্টার খসে পড়েছে আর অসংখ্য ময়লা দাগ। মেঝেটা ভীষণ নোংরা, কতদিন পরিষ্কার করা হয়নি কে জানে! পুরোটা মেঝে জুড়ে ময়লা কাগজ, খাবারের উচ্ছিদ্দ অংশ আর ধুলবালি জমে আছে।



এখানে আনার পর প্রথম দুই দিন শাহিন খুব কেঁদেছে। ১৫ বছর বয়স হয়েছে, এখনও সে মাকে ছেড়ে একটা রাত কোথাও থাকেনি। তবে গতকাল থেকে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছে শাহিন। “বিপদে ধৈর্য ধরতে হয়”- এই শিক্ষা সে তার মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছে।



শাহিন শুয়ে ছিল, দরজা খোলার আওয়াজ শুনে উঠে বসল। কেউ একজন ভেতরে ঢুকছে। দরজা খুলতেই বদির মুখটা শাহিনের নজরে এল। বদির হাতে দুইটা কলা আর একটা পাউরুটির প্যাকেট। তার মুখে হাসি। ভেতরে ঢুকেই প্রশ্ন করল, “কেমন আছ শাহিন?”

শাহিন কোন জবাব দেয়না।

“সকাল থেইকা কিছু খাও নাই। এই যে তোমার লেইগা কলা-পাউরুটি আনছি”।

“খাবনা”। সংক্ষেপে জবাব দিল শাহিন।

“ক্যান খাবানা?”

“খিদে পায়নি”।

“সেই রাইতে খাইছ আর এখন বাজে বেলা ১২টা। কইতাছ খিদা পায় নাই!” বদি লক্ষ করল গতকার রাতে বিরিয়ানির প্যাকেটটা সে যেখানটায় রেখে গিয়েছিল সেটা ঠিক সেখানেই আছে। বদি বিরিয়ানির প্যাকেট খুলে দেখল শাহিন সেটা ছুয়েও দেখেনি। “ইয়া খোদা! তুমি দেখি রাইতেও খাও নাই। ঐ পোলা এমনে না খাইয়া থাকলে তো মইরা যাইবা”।

শাহিন নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, “এমনিতেই যখন মরতে হবে, তখন খেয়ে আর লাভ কি?”

“ধুর পাগল! তুমি মরবা কেন? আর তিন চার দিন বাদেই তোমারে ছাইড়া দিমু আমরা। তোমার মায় টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করতেছে”।

হঠাৎ করেই শাহিনের চোখে পানি চলে এল। সে অতি কষ্টে কান্না চেপে রেখে বলল, “ভাই, আপনারা আমার মাকে এত কষ্ট দিয়েন না। ৫০ লাখ টাকা আমার মা কিছুতেই জোগাড় করতে পারবেন না। আমাদের সহায় সম্বল কিছুই নাই। আমরা খুব গরীব, কোনমতে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি”।

বদি কি বলবে ভেবে পায়না।

শাহিন বলে চলেছে, “আমাদের আত্মীয় স্বজন কেউ নাই যে এতগুলা টাকা দিতে পারে। ভাই আপনাদের আল্লাহর দোহাই লাগে, এত নিষ্ঠুর হবেন না”।

বদি একটু আমতা আমতা করে বলল, “দেখ.. তোমার কষ্ট আমি বুঝি। তোমার মার লগে আমি কথা কইছি... ধার দেনা করে কিছু টাকা ম্যানেজ কইরা ফালাইছে... তিনি বলছেন বাকি টাকাও ম্যানেজ কইরা ফালাইবেন তিন চার দিনের মধ্যে, মারে নিয়া টেনশন কইর না তুমি”।

শাহিন আর কান্না চেপে রাখতে পারেনা। তার দুচোখের কোন বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু ঝরতে থাকে। সে বলে, “আপনি আমার কষ্ট কি বুঝবেন? আপনি কেমন করে বুঝবেন আমার মা আমার কাছে কি!”

কথাটা বদিকে একটু নাড়া দিয়ে যায়। সে বলে, “হ তুমি ঠিকই কইছ। মা কি জিনিস সেইটা আমি ক্যামনে বুঝমু? বুঝ ক্ষমতা হওয়ার পর থেইকা আমি তো আমার মারে দেখি নাই”।

শাহিন একটু শান্ত হল। জিজ্ঞেস করল, “আপনার মার কি হয়েছিল?”

“শুনছি আমার মায় পানিতে ডুইবা মরছে। আমার মার আত্মা ঐ পানিতে মিশশা আছে। আমি যখন পানিতে ডুব দেই সারা শরীরে কেমন জানি একটা আরাম লাগে, মনে হয় মায় আমারে আদর করতাছে! তাই মাঝে মাঝে এই বাড়ির পিছনের পুস্কুনিটাতে গিয়া ইচ্ছা মত ডুব দেই আর মা মা কইয়া চিক্কুর পাইড়া কান্দি। মারে খুঁজি পানির তলে, কিন্তু খুইজা তো পাইনা...” বলতে বলতে বদিও কেঁদে ফেলে।



শাহিন অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। কিছুক্ষন নীরবে কাঁদল বদি, তারপর সামলে নিয়ে নরম গলায় বলে, “কিন্তু তোমার মা তো বাইচা আছেন। তিনি যদি টাকা জোগাড় করে এসে দেখে তুমি না খাইতে খাইতে মইরা গেছ তাইলে ক্যামনে হবে? তোমার মা তো টাকা জোগাড় করতাছে তোমারে বাঁচানোর জন্য তাইনা? অহন টাকা আর পোলা দুইটাই হারাইলে উনি বাঁচব কি নিয়া?”

শাহিন দুহাত দিয়ে চোখের পানি মুছে নিল।

বদি তার দিকে কলা পাউরুটি এগিয়ে দিতে দিতে বলল, “লও লও খাইয়া লও। খাইয়া নিজেরে সুস্থ রাখ”।

“একটা কথা জিজ্ঞেস করব আপনাকে, সত্যি জবাব দিবেন?”

“কি কথা?”

শাহিন একটা কলা ছিলতে ছিলতে প্রশ্ন করল, “টাকা নেওয়ার পর আমাকে কি আসলেও জীবিত অবস্থায় আমার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেবেন?”

“কেন দিমুনা?”

“না, আমি শুনেছি এই রকম কিডন্যাপ করার পর, কিডন্যাপাররা টাকা নিয়ে যাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে তাকে মেরে রেখে পালিয়ে যায়”।

“কে বলছে এই বোগাস কথা?”

“পেপারে পড়েছি”।

“এই সব ভুয়া খবর। আমাগো ওস্তাদ অনেক ভালা মানুষ। কথা দিলে কথার বরখেলাপ করেন না। তোমার মায় টাকা নিয়া আসলে তোমারে সুস্থ অবস্থায় তার কাছে ফিরায় দেওয়া হইব”।



শাহিন আর কথা না বলে খেতে থাকল। কিন্তু বদি তখন চিন্তায় পড়ে গেছে। অনেক গুলো প্রশ্ন জমেছে তার মনে। সে কি তার ওস্তাদকে আসলেও চেনে? ওস্তাদ কি আসলেও ছেলেটাকে জীবিত অবস্থায় মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেবে? শাহিন তাদের সবাইকে চিনে রেখেছে, এই বাড়িটি কোথায় সেটাও তার জানা, ছাড়া পেয়ে যদি পুলিশের কাছে গিয়ে সব তথ্য বলে দেয় তাহলে তাদের সবাইকে জেলের ভাত খাওয়া লাগবে। এই রিস্ক কি পাগলা মজিদ নেবে?

মনে মনে ঠিক করে নিল বদি। যা হয় হবে, পাগলা মজিদ যদি এই ছেলেটাকে মের ফেলে তাহলে সে নিজ হাতে নিজের ওস্তাদকে খুন করবে!



***



“মহিলা টাকা জোগাড় কইরা ফেলছে?”

“হ বড়ভাই”। আলামিন উত্তর দিল।

মজিদ বলল, “ঠিক আছে। তুই মহিলারে কইয়া দে টাকা নিয়া রেললাইনের পাশের বস্তির ভিতরে আমাগো যে আস্তানা আছে সেইখানে আইতে। তুই লুকাইয়া লুকাইয়া সারা পথে নজর রাখবি মহিলার লগে আর কেউ আছে কিনা। বুঝতে পারসস?”

“জী, বড়ভাই”।

“ঠিক আছে যা”।

আলামিন চলে যেতেই বদির দিকে ফিরল মজিদ, “বদি তুই আস্তানায় গিয়া সব ঠিক ঠাক কইরা রাখ। আমি আইতাছি পোলাটারে নিয়া”।

বদি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় তার ওস্তাদের দিকে।

“কি? কিছু কবি?”

“ওস্তাদ আপনি আস্তানায় জান না। আমি পোলাটারে নিয়া আসতেছি”।

মজিদ একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “আবার আমার মুখের ওপর কথা কইতাছস? যেইটা কইলাম সেইটা কর। যা, আস্তানা ম্যানেজ কর। আমি আইতাছি”।

ভয়ের একটা স্রোত বদির মেরুদণ্ড বেয়ে নামে। ওস্তাদের কথা তার বিশ্বাস হয়না। তার ওস্তাদ হিসেবি মানুষ। সম্ভবত ছেলেটাকে জীবিত অবস্থায় মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে চায়না।

“কিরে খাঁড়ায় আসস কেন খাম্বার মত? কথা কানে যায় নাই?”

“জী বড়ভাই”।

“দৌড় লাগা হারামজাদা”।

“বড়ভাই একটা কথা...”

“যা কইসি জলদি কর বদি। মেজাজ বিলা করিস না”।

“ভাই, পোলাটা মায়ের খুব আদরের... পোলাটারে না পাইলে মা টা বাঁচব না...”



পাগলা মজিদ গরম চোখে তাকিয়ে থাকল বদির দিকে। বদি ঐ চাউনির সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলার সাহস পেলনা। চুপ চাপ চলে এল আর মনে মনে বলতে থাকল, “আল্লাহ। আমার ওস্তাদের মনে একটু দয়া দিও। সে যেন পোলাটারে মাইরা না ফালায়!”



***



দড়াম করে ঘরের দরজা খোলার আওয়াজ হল। শাহিন দেখল ঘরে ঢুকছে পাগলা মজিদ। মজিদের হাতে ধরা জিনিসটা যে একটা পিস্তল সেটা বুঝতে কোন সমস্যা হলনা শাহিনের।

“ঐ পোলা। তোর মা তো টাকা নিয়া আইতাছে”।

কথাটা শুনে শাহিন খুশি হতে পারছে না। তার সমস্ত মনোযোগ মজিদের হাতে ধরা পিস্তলের দিকে।

“অহন তোর লগে দুইটা কথা কওন দরকার”।

“কি কথা?” ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল শাহিন।

“তুই এই এলাকা চিনে রখাছস। আমারা যারা যারা তোরে ধরছি তাগোরেও তুই চিনস। তুই ছাড়া পাওনের পর কি পুলিশের কাছে সব খবর ফাস কইরা দিবি?”

“না। আমি কাউকে কিচ্ছু বলব না”।

“কথাটা কেন জানি বিশ্বাস হইতাছে না”।

“বিশ্বাস করেন ভাইজান। আমি কাউকে কিচ্ছু বলব না”। শাহিনের কণ্ঠে বাঁচার আকুতি।

“তুই পোলাটা তেজি স্বভাবের। এমন পোলাদের দিয়া ভরসা নাই। কেন জানি লাগতাছে তুই বাইর হইয়া আমগোরে ধরা খাওয়াইয়া দিবি”।

শাহিন বুঝতে পারলনা কি বলা উচিত।

“আমাগো টাকা পাওয়া নিয়া হইছে কথা। তোর মায় টাকা নিয়া আইতাছে। তোরে বাঁচায় রাখি আর মাইরা ফেলি তাতে কিচ্ছু হইব না। টাকা আমরা ঠিকই পামু। বাঁচায় রাখাটা তো আমাগোর জন্য রিস্ক”।



এবার ব্যাপারটা পরিষ্কার হল শাহিনের কাছে। মজিদ আসলে একটা কারন খুজছে তাকে মেরে ফেলার জন্য। মায়ের সাথে আর দেখা করার সুযোগ হয়ত সে পাবেনা। হঠাৎ করে শাহিন নিজের নিয়তিটা মেনে নিল। বলল, “ভাইজান একটা অনুরোধ রাখবেন?”

“কি? জলদি বল”।

“আমাকে মেরে ফেলেন, আপত্তি নাই। শুধু আমার মায়ের কাছ থেকে টাকাটা নিয়েন না। জীবনে আপনারা টাকা অনেক কামাতে পারবেন। শুধু আমার মাকে একটু মুক্তি দিন। ঐ টাকা তিনি ঋণ করে আনছেন। বাকিটা জীবন তাকে সেই ঋণের বোঝা বইতে হবে। আমি মরে যেতে রাজি আছি কিন্তু আমার মায়ের একটু কষ্টও দেখতে রাজিনা”।

মজিদ ঝাড়া দুই মিনিট কিছু একটা চিন্তা করল। সম্ভবত সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কি করবে। তারপর মনঃস্থির করে নিল, “ঠিক আছে। তোরে মারলাম না। কিন্তু মনে রাখিস, ভুলেও এই এলাকার ধারে কাছে আর আসবি না। পুলিশে যাওয়ার কথা ভাবলেই তোদের মা ছেলেরে এক্কেবারে উপরে পাঠায় দিমু। মনে থাকব?”

শাহিন আর কিছু বলল না। ছলছল চোখে উপরে নিচে মাথা ঝাকাল শুধু।



***



বস্তির ভেতরে এই ঘুপচির মত বেড়ার ঘরটা পাগলা মজিদের অস্থায়ী ডেরা। ভেতরে একটা টেবিল আর কিছু চেয়ার পাতা আছে। মাঝে মাঝে মদ আর জুয়ার আসর বসে এখানে। বহুগামি রমণীদের নিয়ে এসে দুই চার ঘণ্টা নিভৃতে সময় কাটানোর জন্য এর চেয়ে উত্তম কিছু হয়না। মজিদ অবশ্য মাঝে মধ্যে সুযোগ বুঝে যায়গাটাকে ধান্দার কাজে লাগায়। এই যেমন আজ কাজে লেগে গেল!

একটা চেয়ারে বসে আছে মজিদ। পাশে বসিয়ে রেখেছে শাহিনকে। বদি দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। বদির চোখে মুখে এক ধরনের চাপা আনন্দ। তার কেবল মনে হচ্ছে সে আসলে যতটা খারাপ ভাবে, তার ওস্তাদ ততটা খারাপ না। শাহিনকে সুস্থ অবস্থায় তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার যে কথা দিয়েছিল সেটা সে রাখতে পারবে ভাবতেই ভাল লাগছে।



আলামিন ঘরে ঢুকে খবর দিল, “রাহেলা বেগম আসছে”।

“রাহেলা বেগমটা আবার কেডা?” বিরক্ত হল মজিদ।

“রাহেলা বেগম... ঐযে স্কুলের মাষ্টারনি। এই পোলার মা”।

“ওহ! ওনারে ভেতরে নিয়া আয়”।



রাহেলা বেগম ভেতরে এসে ঢুকলেন। মহিলার বয়স পঞ্চাশের মত। এই মুহূর্তে তাকে আরও বেশি বয়স্ক মনে হচ্ছে। গত কয়েকদিনের ধকলে একেবারে কাহিল হয়ে পড়েছেন। কিন্তু ভেতরে ঢুকে শাহিনের ওপর চোখ পড়তেই তার চোখে মুখে এক অপার্থিব আনন্দ ফুটে উঠল। সাতদিন হয়েছে ছেলেকে দেখেননি, এখন মনে হচ্ছে কত্ত বছর পরে দেখছেন! শাহিনও তার মাকে দেখতে পেয়ে কেঁদে ফেলল। কিন্তু এইসব দৃশ্য মজিদের চোখে পড়ছে না। সে একদৃষ্টিতে রাহেলা বেগমের দিকে তাকিয়ে থাকল। তার মাথায় রাহেলা বেগম নামটা ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছে। সে প্রশ্ন করে বসল, “আপনার নাম রাহেলা বেগম?”

রাহেলা বেগমের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। তিনি কঠিন গলায় বললেন, “হ্যা, কোন সন্দেহ আছে? আর নাম দিয়ে আপনার দরকার কি? আপনি টাকা চেয়েছেন আমি এনেছি, চাইলে গুনে নিতে পারেন। একটা টাকাও কম হবেনা বরং বেশি হতে পারে”।

মজিদ যেন তখন চলে গেছে অন্য কোন জগতে। সে তখন আর কোন কথা বলার পর্যায়ে নেই। তার চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি। তাকিয়ে আছে রাহেলা বেগমের মুখের দিকে। এক মুহূর্তের জন্য চোখ সরাচ্ছে না।

“এই যে টাকা নিন। ব্যাগটা ছুড়ে দিলেন রাহেলা বেগম মজিদের দিকে। ছেড়ে দিন আমার ছেলেকে”।

মজিদ ব্যাগটা ধরল না। শুধু মুখে বলল, “আমি আপানার ছেলেরে ছাইড়া দিতাছি। আপনি টাকাও নিয়ে যান। আমি টাকা চাইনা, অন্য একটা জিনিস চাই আপনার কাছে”।

“অন্য জিনিস?” রাহেলা বেগমের চোখে মুখে ঘৃণার অভিব্যাক্তি। সম্বোধন আপনি থেকে তুইতে নামিয়ে আনলেন, “আর কি চাস তুই? আমার গায়ের রক্ত চাস?”

“একবার শুধু আপনারে...”

“আমাকে কি? আমাকে কি করতে চাস? কথা শেষ কর জানোয়ার!”

“মা কইয়া ডাকতে চাই!”



প্রথমে একটু অবাক হলেন রাহেলা বেগম। এমন কিছু শুনবেন সেটা আশা করেন নি। কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল তার নিজেকে সামলে নিতে। তারপর গর্জে উঠলেন, “খবরদার! আমি মরে যেতে রাজি আছি কিন্তু তোর মত একটা বেজন্মা কুকুরের মুখে মা ডাক শুনতে পারব না”।

মজিদের চোখে তখন জল টলমল করছে। গত পাঁচ বছরে বদি আর আলামিন তাদের ওস্তাদকে কখনো কাঁদতে দেখেনি। নিজের চোখকে তারা বিশ্বাস করতে পারছে না। মজিদ অনুনয় করল, “একবার... শুধু একবার আপনেরে মা কইয়া ডাক দিতে চাই। আমার আর কিচ্ছু চাইনা”।

“নাহ! তোকে ৫০ লাখ দিয়েছি, লাগলে আরও দেব। কিন্তু তোকে মা বলে ডাকার অনুমতি দিয়ে আমি মা শব্দটাকে কলঙ্কিত করতে পারব না”। রাহেলা বেগমের কণ্ঠে একই সাথে রাগ, ঘৃণা ও বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ।

“শুধু একবার ডাকমু... আর কোনোদিন ডাকমু না”! মজিদ কণ্ঠে প্রবল আকুতি।

কিন্তু সেই আকুতিতে রাহেলা বেগমের মন গলল না। তিনি শাহিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “চলে আয় শাহিন”। এই সব তামাশা দেখতে আর ভাল লাগছে না”।



শাহিন উঠে এল। তাকে একবার বুকে জড়িয়ে নিয়ে কপালে চুমু খেলেন রাহেলা বেগম। সংক্ষিপ্ত পুনর্মিলনী শেষে মা ছেলে বেরিয়ে গেল মজিদের আস্তানা ছেড়ে।

বদি আর আলামিনকে হতবাক করে দিয়ে হঠাৎ তাদের ওস্তাদ পাগলা মজিদ শব্দ করে কেঁদে উঠল। তার চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছে। ওস্তাদের এই অন্যরকম রুপ দেখতে প্রস্তুত ছিলনা তারা। এমন শক্ত আর পাথর প্রকৃতির একটা মানুষ কাউকে মা ডাকার সুযোগের না পেয়ে এভাবে ভেঙে পড়তে পারে, এই চিন্তা তাদের কল্পনায়ও কখনো আসার অবকাশ পায়নি।



বদি এগিয়ে এল, বলল, “কি হইল বড়ভাই? কান্দেন কেন?”

মজিদ কিছু বলছে না দেখে সে আবার প্রশ্ন করল, “ঐ মহিলারে একবার মা ডাকার বিনিময়ে আপনে ৫০ লাখ টাকা ফিরায় দিতে চাইছিলেন বড়ভাই! ক্যান?”

মজিদ কান্না জড়ানো গলায় বলল, “আরে! তোরা বুঝবি না রে! আমার মায়ের নাম ছিল রাহেলা বেগম”।

“কি কন বড়ভাই!"

“ আমার বাপ আমার জন্মের আগে মইরা গেছিল। আমাগো অভাবের সংসার ছিল। আমার যখন ২ বছর বয়স, আমার নানী আমার মারে না জানাইয়া আমারে রাইখা আসছিল এতিম খানায়। আর আমার মাও সুখের আশায় অন্য এক লোকরে বিয়া কইরা পালায় গেছিল। আর কোনদিন বাড়ি ফিরে নাই। এতিম খানা থেইকা বাইর হওয়ার পর ১০ বছর ধইরা আমি মারে খুঁজতাছি। আইজ ও তার দেখা পাইলাম না!”

“বড়ভাই! এমনও তো হইতে পারে এই মহিলা আপনার মা! আপনি কেন পরিচয় দিলেন না বড়ভাই?”

"ভয় পাইছিরে বদি। বড় ভয় পাইছি! উনি সত্যি সত্যি আমার মা হইলেও আমি ক্যামনে কমু যে আমি তার পোলা? কোন মুখ নিয়া কমু? আমার মায় যখন জানব তার পোলা বড় সন্ত্রাসী হইছে সেইটা কি সে সহ্য করতে পারব?”

বদির একবার মনে হল বলে যে, “আপনের মায় হেইদিন ভাইগা গেছিল দেইখাই তো আপনে আজকে সন্ত্রাসী হইছেন। মায়ের আদর ভালবাসা পাইলে তো এমন হইত না”! কিন্তু ওস্তাদের মা সম্পর্কে খারাপ কিছু বলার সাহস তার হলনা। শুধু বলল, “বড়ভাই, একটা কথা শুনবেন?”

মজিদ নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করল, “কি?”

“আপনের মায় আপনেরে ফালাইয়া গেছে কিন্তু আমার মায় তো আছে। চলেন আমার মায়ের কাছে যাই। আমার মায় কাউরে কম আদর করেনা”।



মজিদ উঠে দাঁড়ায়। বদির সাথে বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। আলামিন কিছুক্ষণ কি করবে ভেবে না পেয়ে শেষে সেও বদি আর মজিদের পিছু নেয়। এদিকে ঘুপচির মত ঘরটাতে যে ৫০ লাখ টাকা ভর্তি একটা ব্যাগ পড়ে রয়েছে, সেটা কারো খেয়াল থাকেনা।



কিছুক্ষন পর রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকজন হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকল, ভর-দুপুরে তিনটা মানুষ পুকুরে ক্রমাগত ডুব দিচ্ছে আর আর অনবরত “মা” “মা” বলে চিৎকার করে কাঁদছে...



(সমাপ্ত)



***************************

গল্প প্রসঙ্গেঃ



কিছুদিন আগে ব্লগার স্বপ্নবাজ অভি তার একটা পোস্টে সবাইকে আমন্ত্রন জানিয়েছিলেন মা কে নিয়ে ভাল ভাল আর্টিকেল, গল্প, কবিতা ইত্যাদি লেখার জন্য। কারন গুগলে সার্চ করলে প্রথমে বেশ কিছু বাজে সাইটের লিংক আসে। অনেকেই সেই আহবানে সাড়া দিয়েছেন। জননী গল্পের মাধ্যমে আমিও এই মিছিলে শামিল হলাম। আর সঙ্গত কারনেই গল্পটা স্বপ্নবাজ অভিকে উৎসর্গ করছি।



আর একটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। গুগলে সার্চ করলে সেই লিংকগুলো আগে চলে আসে যেগুলোতে বেশি বেশি হিট পড়ে। তাই মাকে নিয়ে ভাল ভাল লেখা লিখলেই চলবে না। সেগুলো যথেষ্ট পরিমান মানুষ পড়তে হবে এবং বেশি হিট থাকতে হবে। নইলে আমাদের উদ্দেশ্য অপূর্ণ থেকে যাবে। আপনাদের প্রতি অনুরোধ করব, মাকে নিয়ে লেখাগুলো আপনারা পড়বেন এবং অন্যকে পড়তে উৎসাহিত করবেন। তাহলেই আমরা বাজে সাইটগুলোকে হারিয়ে ভাল লেখাগুলো সামনে নিয়ে আসতে পারব।
 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on October 26, 2013 18:13

October 22, 2013

এক টুকরো অন্ধকার

আবিদ ভাই বাসের জানালা দিয়ে তার বকের মত লম্বা গলাটা বাড়িয়ে চিৎকার করছেন, “কি ব্যাপার আজহার? এত দেরি করছ কেন? আমরা কিন্তু বাস ছেঁড়ে দিচ্ছি!”

ব্যাগপ্যাকটা কাঁধে তুলে নিলাম। রাতুলকে ছাড়া দূরে কোথাও ট্যুরে যাচ্ছি ভাবতে ভাল লাগছে না আমার। আমি রাতুলের কাঁধে একটা হাত রাখলাম, “তুই আমাদের সাথে আসতে পারলে ভাল লাগত দোস্ত!”

রাতুল বিষণ্ণ মুখে বলল, “আম্মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে না পড়লে অবশ্যই আসতাম”!

আমি একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে বললাম, “আনটি ভাল হয়ে যাবে দোস্ত। আমি দোয়া করি ওনার জন্য। উঠে পড়ি তাহলে বাসে?”

রাতুল হাসল, “হ্যা যা। শুধু একটা কথা মনে রাখিস। প্রবালের দিক থেকে সাবধান! ও কিন্তু আগে থেকেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে এই ট্যুরে গিয়ে লিজাকে পটিয়ে ফেলবে”।

আমিও হাসলাম। বললাম, “চিন্তা করিস না, প্রবাল ফাজলামি করেছে। আর তাছাড়া ওকে আমি লিজার কাছে ঘেঁষতেই দেবনা”।

রাতুল আমার পিঠ চাপড়ে দিল, “বেষ্ট অফ লাক বন্ধু!”



বাসে উঠে পড়লাম। দুই একটা রো পরেই দেখলাম লিজা আর স্নিগ্ধা পাশাপাশি বসে ছিল। তাদের পেছনের সিটে প্রবাল বসে আছে, প্রবালের পাশের সিটটা খালি। স্নিগ্ধা আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। চোখের ইশারায় কিছু একটা ইঙ্গিত করল। আমি এগিয়ে গেলাম। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আজহার, তুই লিজার পাশে বসে যা। আমি পিছনে যাচ্ছি। প্রবালের সাথে কিছু জরুরী কথা আছে আমার”।

স্নিগ্ধা উঠে যেতেই আমি মাথার ওপরের কম্পারটমেন্টে ব্যাগটা রেখে বসে পড়লাম লিজার পাশে। স্নিগ্ধা হচ্ছে আমার ক্লাসমেট প্লাস বেষ্ট ফ্রেন্ডদের একজন। লিজা তার কাজিন। বয়সে সে আমাদের দুই এক বছরের ছোট হতে পারে।

শেষ মুহূর্তে আর একটা ছেলে দৌড়ে এসে বাসে উঠল। এর নাম কমল। ছেলেটার চরিত্র খুব খারাপ। এমন কোন বাজে কাজ নাই যা সে করে না। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বড় বড় চোখ করে লিজাকে দেখছিল, তার দু চোখ জুড়ে লালসার সুস্পষ্ট প্রকাশ। আমার মেজাজ খারাপ হল। মনের ভেতর প্রচণ্ড ক্রোধ জেগে উঠল, ইচ্ছে হচ্ছিল একটা ভারী পাথর দিয়ে ওর মুখটা থেতলে দেই অথবা একটা চাকু হাতে নিয়ে ছেলেটার চোখদুটো উপড়ে ফেলি। হারামির বাচ্চার সাহস কত! লিজার দিকে নোংরা দৃষ্টিতে তাকায়!



বাস ছেঁড়ে দিয়েছে। সমুদ্র ভ্রমনে যাচ্ছি আমরা। সমুদ্র আমার কখনোই ভাল লাগেনা। বিশাল জলরাশির সামনে দাঁড়ালে নিজেকে অতি তুচ্ছ, অতি নগণ্য মনে হয়। আমি নিজেকে খুব ভালবাসি, নিজেকে ছোট ভাবতে ভাল লাগেনা। নিজের রিক্ততাটুকু যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে, খারাপ তো একটু লাগেই।

লিজা তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে। চাঁদের আলোয় ব্যস্ত সড়ক দেখছে। অসম্ভব সুন্দর একটা চাঁদ আকাশে। এই চাঁদ না দেখা মানে প্রকৃতির এক অদ্ভুত সৌন্দর্য অজানা থেকে যাওয়া। শরৎ এর পরিস্কার আকাশে ঝকঝকে রুপালী আলো ছড়িয়ে দেয়া বিশাল এক চাঁদ। এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলে মনটা অন্যরকম এক আনন্দে ভরে যায়। মনে হচ্ছে আজ পূর্ন পূর্নিমা হবে। কিন্তু চাঁদ দেখার আগ্রহ আমার হচ্ছেনা। আমি দেখছি লিজাকে। আমার চোখদুটোর সকল ব্যস্ততা গিয়ে ঠেকেছে লিজার অপরুপ মুখশ্রীতে। চাঁদের আর কি প্রয়োজন? সমস্ত পৃথিবীতে জ্যোৎস্না ছড়াতে এই মেয়েটির এক ফালি হাসিই যথেষ্ট।



লিজার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল বন্ধুদের এক আড্ডার আসরে। স্নিগ্ধার সাথে দেখা করতে সে আমাদের ক্যাম্পাসে এসেছিল। সে সময়টা আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ম্যারাথন আড্ডা দিতাম। কোন নির্দিষ্ট বিষয় থাকত না আলাপের। এই কথা বলছি খেলা নিয়ে, হঠাৎ চলে যাই রাজনীতিতে, আবার ফিরে আসি মুভি বিষয়ক আলোচনায়। স্নিগ্ধা লিজাকে এনে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। প্রথম দেখাতেই মেয়েটির রুপ সৌন্দর্যে আমি পুরোপুরি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বেশ কিছুক্ষন নানা বিষয়ে কথা বললাম তার সাথে। অল্প কিছুক্ষণ বাদেই আমরা আবিস্কার করলাম পরস্পরকে “তুমি” করে বলছি। কথায় কথায় আমাদের দুজনের বেশ কিছু কমন ইন্টারেস্ট এর বিষয় উঠে এল।

সেদিনের পর থেকে লিজা প্রায়ই আসত আমাদের সাথে আড্ডা দিতে। অবশ্য বেশিরভাগ সময় আমার সাথেই কথা বলত। আড্ডার বাইরে মাঝে মাঝে ফোনে, ফেসবুকে কথা হত দুজনের। কিছুদিন বাদেই বন্ধুরা আমাকে আর লিজাকে জড়িয়ে মজা করতে শুরু করল। আমি প্রথমদিকে একটু আপত্তি করতাম কিন্তু লিজা দেখলাম বিষয়টাতে মজা পাচ্ছে। তাই আমিও আর বাঁধা দেইনি। একটা সময় অনুভব করলাম আই এম ইন লাভ উইথ হার। বন্ধুদের কাছে বিষয়টা প্রকাশ করতেই তারা উঠে পড়ে লাগল আমাদের কাপল বানিয়ে দেয়ার জন্য।

এখন পোস্ট গ্রাজুয়েশনের শেষ দিকে আমরা। কেবল ফাইনাল পরীক্ষা বাকি। ডিপার্টমেন্ট থেকে হঠাৎ কক্সবাজার- সেন্ট মারটিন ট্যুরে যাওয়ার কথা উঠল। বন্ধুরা সবাই মিলে স্নিগ্ধাকে ধরল যেন গেস্ট হিসেবে যেন এই ট্যুরে আমাদের সাথে লিজাকে যেতে রাজি করায়। উদ্দেশ্য একটাই- ট্যুরে গিয়ে আমি লিজার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাব, একান্তে কথা বলার সুযোগ হবে! লিজাকে রাজি করাতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। দুই এক কথাতেই সে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।



****



আধাঘণ্টার মত কেটে গেছে। একটা কথাও হয়নি দুজনের মাঝে। লিজার দৃষ্টি অনুসরন করে মাঝে মাঝে জানালার বাইরে তাকাচ্ছি আমি আর ভাবছি কি বলে লিজার সাথে কথা শুরু করা যায়। একবার আড্ডা জমিয়ে ফেলতে পারলেই হবে। তারপর যা বলার লিজাই বলবে, আমাকে আর কিছু করতে হবেনা।

লিজা হঠাৎ ইয়ারফোন বের করে কানে লাগাল। একটা মানুষ কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনতে থাকলে তার পাশে বসে আড্ডা জমানো সম্ভব হয়না। আমি চেষ্টা করলাম তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে। “লিজা দেখ! কি সুন্দর চাঁদ! এত চমৎকার জ্যোৎস্না আগে কখনো দেখেছ?”

লিজা কান থেকে ইয়ারফোন খুলে চাঁদের দিকে তাকাল। একবার শুধু বলল, “সুন্দর”। তারপর আবার ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে গান শোনায় মনযোগী হল।

এভাবে তো হয়না! মনে হয়না আজ প্রকৃতি দেখার প্রতি তার কোন আগ্রহ আছে। বেশ মুডি রুপ ধারন করেছে আজ। অন্য কোন বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে। এই মেয়েকে জীবনসঙ্গী করলে ঠেলা আছে, মুডি মেয়েদের মন রক্ষা করে চলা সহজ ব্যাপার না।



অবশ্য জীবনসঙ্গী হিসেবে আমার পছন্দ একজন সাদাসিধে বাঙ্গালী কন্যা। সারাদিনের অফিস শেষে আমি যখন ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরব সে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে। মেয়েটির কপালে জমে থাকবে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে আমার হাত থেকে অফিসের ফাইলটা নিয়ে সুন্দর যায়গায় রাখবে, আমাকে জুতো খুলতে সাহায্য করবে, বেসিনে হাত মুখ ধোয়ার সময় এগিয়ে দেবে পরিস্কার তোয়ালে। রাতে খাবার সময় হঠাৎ লোডসেডিং হলে হাত পাখা নিয়ে এসে বাতাস করবে। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে প্রশ্ন করবে, “আজ অফিসে অনেক কাজ ছিল তাইনা?” “তোমার মুখটা অমন শুকিয়ে গেছে কেন?” “বস কি দুর্ব্যবহার করেছে নাকি?” “রাস্তায় আসার সময় কি প্রচুর জ্যাম ছিল?” ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি ডাল-ভাত মাখিয়ে মুখে লোকমা তোলার ফাঁকে হঠাৎ খেয়াল হতেই জিজ্ঞেস করব, “তুমি খেয়েছ তো?” মেয়েটি ঈষৎ হেসে বলবে, “তুমি খাওয়ার পর খাব”। আমি আমার প্লেটের মাখানো ভাত থেকে তাকে নিজ হাতে দুই এক লোকমা খাইয়ে দেব।

কিন্তু লিজা মোটেও তেমন মেয়ে নয়। তার হাতে গৃহস্থালি কাজ মানায় না। ওর জন্ম হয়েছে সাজ গোঁজ করে সারাদিন পুতুলের মত বসে থাকার জন্য। যে ঘরে যাবে সে ঘরে সূর্যের আলোর প্রয়োজন হবেনা, লিজা তার রুপের আলোয় আলোকিত করে রাখবে।

অবশ্য লিজা ঘরে থাকার মত মেয়েও না। সে খুব বেশি ক্যারিয়ার ওরিয়েন্টেড। ভাল একটা জব করার ইচ্ছে তার। মেয়েটি কিন্তু অভিনয়ে নামলেও খারাপ করবে না। আকর্ষণীয় চেহারা, ফিগার, গলার ভয়েজ সব মিলিয়ে খুব দ্রুতই আসন গেঁড়ে বসতে পারবে মিডিয়া ভুবনে।

শুধু তাই নয়। লিজা ভাল গান গায়, নাচেও পারদর্শী। আমি জানি এত গুনে গুণান্বিত একটা মেয়েকে বিয়ে করে আমি ঘরের বউ করে রাখতে পারব না। তারপরও আমি তাকে ভালবাসি। নিজের যত পছন্দ সব ত্যাগ করতে রাজি আছি আমি, তবু এই মেয়েকে আমার চাইই চাই।



লিজা রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে। আমি জানি রাজনৈতিক বিষয়গুলো তাকে খুব ভাবায়। ফেসবুকে একটা ২০,০০০ লাইক সমৃদ্ধ পেইজ চালায় সে, যেখানে নিয়মিত সে বর্তমান রাজনৈতিক চালচিত্র নিয়ে সে আপডেট দেয়। রাজনীতি নিয়ে তার সাথে কি কথা বলা যায় ভাবছি তখন পাশ থেকে কেউ একজন বলল, “হায় লিজা!”

আমি তাকিয়ে দেখলাম প্রবাল দাঁড়িয়ে আছে। লিজাও দুষ্টামির ভান করে বলল, “হায় প্রবাল”।

প্রবাল হাসি মুখে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাসের সামনের দিকে হেঁটে গেল। সম্ভবত কারো সাথে কথা বলবে। আমি কথা বলার চেষ্টা করলাম লিজার সাথে। “তোর কি মনে হয় লিজা? সরকার পদ্মা ব্রিজ নিয়ে যা করল তার পেছনে কি কোন কূটনৈতিক চাল আছে?”

লিজা ঠোঁট উল্টে বলল, “তার আমি কি জানি?”

আমি অবাক হওয়ার ভঙ্গী করে বললাম, “কে বলছে একথা? রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে যে জ্ঞানধর্মী বক্তৃতা দেয় সে!”

লিজা হাল্কা একটু হাসল।

আমি রাজনৈতিক প্রসঙ্গ ধরে রাখতে চাইলাম, “আচ্ছা ওটা বাদ দেও। কিন্তু বিরোধী দল এই যে দুই বেলা কোন কারন ছাড়াই লাগাতার কর্মসূচি দিচ্ছে, অথচ রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে তেমন কোন কথা বলছে না। তোমার কি মনে হয়? এর পিছনে কি কারন থাকতে পারে??”

“সেটা তাদের মর্জি, আমরা কি বলব?”

“কিন্তু তোমার কি মনে হয়না এখানে ভারতের কোন চাল আছে?”

“থাকলে থাকতে পারে”।

আমি হয়ত আরও কিছু বলতাম কিন্তু দেখলাম যে প্রবাল ফিরে আসছে। আমাদের সিটের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। গালে হাত দিয়ে লিজার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লিজা ব্যাপারটা খেয়াল করে প্রবালকে জিজ্ঞেস করল, “কি ব্যাপার?”

প্রবাল শুরু করল তার চিরায়ত ফ্লরটিং। “দেখি”।

“কি দেখ?”

“আল্লাহতালার অপরুপ সৃষ্টি”।

রাগে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলছে। কিন্তু লিজার মুখে অদ্ভুত সন্দর একটা হাসি ফুটে উঠল। এমন হাসি কি সে কখনো আমার সামনে হেসেছে?

আরও কিছুক্ষন চলল তাদের ইঙ্গিতপূর্ণ বাক্য বিনিময়। আমি চুপচাপ তাকিয়ে থাকলাম সামনের দিকে। লিজা আজ আমাকে একটু এভয়েড করছে মনে হয়! কারনটা কি?



আরও ঘণ্টা খানেক কেটে গেল। লিজার সাথে কথা বলার সুযোগ মেলেনি। আমি আবার সুযোগ খুজছিলাম কীভাবে কথা বলা যায়! বাস তখন কাচপুর ব্রিজের ওপর। নিচে নদি দেখা যাচ্ছে। আমি না জানার ভান করে লিজাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা এইটা কোন ব্রিজ”।

লিজা হয়ত শুনতে পায়নি। সে কান থেকে ইয়ারফন খুলে জিজ্ঞেস করল, “কি বললে?”

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কোন ব্রিজ?”

লিজা বলল, “তুমি এইটা চিন না!”

আমি বললাম, “ঠিক চিনছি না”।

“আজব ব্যাপার! এইটা কাচপুর ব্রিজ। আগে কখনো আসনি এই পথে?”

“ওহ! মনে পড়েছে”।

আমি মনে মনে হাসলাম। মিথ্যে বলে লাভ হয়েছে, গান শোনা থেকে মনোযোগ সরান গেছে। আমি বলে বসলাম, “আচ্ছা পাকিস্তান এইটা কি করল বলত?”

“কি করেছে?”

“টেস্টে জিম্বাবুয়ের কাছে হেরে গেল! একদম ফালতু হয়ে গেছে দলটা”।

“এটা কোন বিষয় না। খেলায় হারজিত থাকেই”। বলেই আবার ইয়ারফোন কানে গুজে নিল সে।

আমি অবাক হলাম। পাকিস্তান ক্রিকেট দল নিয়ে কেউ বাজে কিছু বললেই লিজা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। এমনিতে আমি পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে একদমই পছন্দ করিনা, কিন্তু লিজার সামনে কিছু বলিনা। অথচ আজ ফালতু বলার পরও সে গায়ে মাখল না!

খুব বেশি খারাপ লাগছে আমার। লিজা আমাকে এভাবে অবহেলা কেন করছে আজ? সে কি টের পেয়েছে যে আমি তাকে নিয়ে ভাবছি? তাতে তো লিজার খুশি হওয়ার কথা। আমাকে অ্যাভয়েড করছে কীভাবে সে? আমি তো ফেলনা নই। লিজার মত অন্তত ১০টা মেয়ে আমার পেছনে ঘোরে। একটু চেষ্টা করলেই এদের সাথে প্রেম ভালবাসা করা, এমনকি বিছানায় নেওয়া সম্ভব। কিন্তু সমস্যাটা হল- ওরা লিজার মত কিন্তু লিজা নয়। আমার লিজাকেই প্রয়োজন, লিজার মত কাউকে দিয়ে আমার চলবে না।



***



কতটা সময় কেটে গেছে জানিনা। আমার ঘুম ঘুম লাগছিল। একটা ঘোরলাগা অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমার যখন মন খারাপ হয় তখন নার্ভাস ব্রেকডাউনের মত একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। লিজার ক্রমাগত অবহেলায় মনটা বিষিয়ে গেছে। ভাল লাগছে না কিছুতেই। এর মাঝে কমলকে কয়েকবার সামনে দিয়ে যাতায়াত করতে দেখেছি। প্রতিবার লোলুপ দৃষ্টির আক্রমন বজায় ছিল। লিজা যে বিষয়টি বোঝেনি তা নয়, নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন সে। কিন্তু জগতে চলতে গেলে সুন্দরী মেয়েদের কিছু কিছু সময় না বোঝার ভান করতে হয়।



বাসটা কুমিল্লা পৌঁছেছে। একটা ফিলিং স্টেশনে বাস থামানো হল গ্যাস নেওয়ার জন্য। আবিদ ভাই ঘোষণা দেওয়ার সুরে বললেন, “এখানে একটা ভাল রেস্টুরেন্ট আছে। চাইলে তোমরা সবাই নেমে কিছু খেয়ে নিতে পার, আমরা কিছুক্ষন যাত্রা বিরতি নিচ্ছি এখানে”।

সবাই একে একে বাস থেকে নামতে থাকল। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করল, “নামবি না?”

“তোরা নাম আমার ঘুম পাচ্ছে। একটু পরে নামি”।



আমি আরও কিছুক্ষন পর একটা ঘোরের মধ্যেই রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। ওরা তিনজন এক কোনায় একটা টেবিল দখল করে বসে ছিল। আমি তাদের পাশে যায়গা করে নিয়ে বসে পড়লাম। প্রবাল কিছু একটা অর্ডার দিল। কি খেলাম ভাল করে লক্ষ করছিনা। ওরা অনেক বিষয়ে হাসি তামাশা করল। আমি কিছু শুনলাম, কিছু শুনলাম না। খাওয়া শেষে ওয়াশরুমে ঢুকে চোখে মুখে ভাল করে পানি দিলাম। তারপর যেন একটু চেতনা ফিরে এল।



বাসে এসে উঠার পর আমি লিজার পাশে বসতে যাব, তখন লিজা বলে উঠল, “তুমি না, তুমি না। আমি প্রবালের পাশে বসব। প্রবালের সাথে আমার অনেক কথা আছে। তুমি পিছনে স্নিগ্ধার সাথে গিয়ে বস”।



আমি পিছনে এসে স্নিগ্ধার পাশে বসলাম। এর মধ্যে একটা খবর এল যে কমল নামের ছেলেটা বাসে ওঠেনি। পুরো ফিলিং ষ্টেশনে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার সন্ধান মিলল না। কমল নেশা করে, কারো বুঝতে অসুবিধা হলনা যে সুযোগ পেয়ে সে কোথাও গিয়ে নেশা টেশা করে পড়ে আছে। মিনিট দশেক অপেক্ষা করা হল তার জন্য। তারপর আবিদ ভাই বিরক্ত হয়ে ড্রাইভারকে ছেড়ে দিতে বললেন। কমলের জন্য কারো সিমপ্যাথি নেই। বরং সে সাথে না থাকলেই সবাই খুশি।



কিছুক্ষনের মধ্যেই সামনের সিটের চিল্লাচিল্লিতে কাল ঝালাপালা হয়ে গেল। প্রবাল যে এত কথা বলতে পারে সে সম্পর্কে আমার কোন আইডিয়াই ছিলনা। ক্লাসের মধ্যে সে সবচেয়ে স্বল্পভাষী ছেলে হিসেবে পরিচিত। অথচ লিজার সাথে দুই মিনিটেই জমিয়ে ফেলেছে। রাজনীতি, খেলাধুলা, মুভি, গ্রামের বাড়ির অভিজ্ঞতা, ভ্রমনের অভিজ্ঞতা- এমন কিছু নেই যা নিয়ে তারা কথা বলছে না। প্রবাল মাঝে মধ্যে ফাজলামি করে বলে সে লিজাকে পটিয়ে ফেলবে। কিন্তু প্রবাল আমার ভাল বন্ধু এবং সে লিজার প্রতি আমার ইন্টারেস্ট সম্পর্কে জানে। প্রবালের কথা সিরিয়াসলি নেয়ার কোন কারন দেখিনা। কিন্তু ওদের এই উদ্যমে ভরপুর আড্ডা আমাকে একমুহূর্তের জন্য স্বস্তি দিচ্ছেনা।

আমি স্নিগ্ধার একটা হাত ধরলাম। তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “ইটস নট ওর্কিং”।

স্নিগ্ধা এক হাত বাড়িয়ে আমার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল, “ইট উইল ওয়র্ক। ডোন্ট গিভ আপ! কিপ ট্রাইং!”



আমি ঘুমানোর চেষ্টায় চোখ বন্ধ করলাম। আকাশ থেকে থোকায় থোকায় কাঁচা সোনার মত জ্যোৎস্না গলে পড়ছে, অদ্ভুত এক হলদে আলোর বন্যায় ডুবে যাচ্ছে দুপাশের গাছগুলো। এ রাতে প্রিয় মানুষের কথা ভাবতে ভাবেতে ঘুমিয়ে পড়তে খুব সাধ জাগে। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নামে না। কানের পাস দিয়ে ছুটে চলা বাতাস ফিসফিস করে গল্প বলে যাচ্ছে। কিসের গল্প কে জানে? শব্দগুলো খুব বেশি দুর্বোধ্য। আমার যদি বাতাসের আর্জি বোঝার সাধ্য থাকত, হয়ত বুঝতে পারতাম কি নিদারুন ব্যাথা নিয়ে তারা অনবরত ছুটে চলে!



***



প্রায় ৪ ঘণ্টা সময় কেটে গেছে। এখনও অন্ধকার চারিদিকে কিন্তু ভোরের সূর্য উকি দিতে আর খুব বেশি সময় বাকি নেই। বাস পৌঁছে গেছে চিটাগং। আবার একটা রেস্টুরেন্টের সামনে বাস থামল। এটা আগেরটার থেকে অনেক বড় রেস্টুরেন্ট। আর একেবারে হাইওয়ের পাশে। ধারে কাছে কোন জনবসতি নেই। রাস্তার দু ধার ঘন গাছ পালায় ঢাকা।

একে একে সবাই নামলাম আবার। স্নিগ্ধা, প্রবাল আর লিজা গেল রেস্টুরেন্টের ভেতরে। আমি ঢুকলাম না। লিজা আর প্রবালের এই পাশাপাশি হাটা আমার ভাল লাগছে না দেখতে। একটা সিগারেট খাওয়া দরকার। মাস খানেক হয়ে গেছে সিগারেট খাওয়া ছেড়েছি। এই মুহূর্তে একটা না খেলেই নয়।

এই পৃথিবী হচ্ছে ধূমপায়ীদের জন্য একটি আদর্শ স্বর্গভূমি। যদি ধুমপান করার ইচ্ছে জাগে তাহলে সাহারা মরুভূমি, আমাজন জঙ্গল কিংবা এন্টার্কটিকায় গেলেও একটা ব্যাবস্থা হয়েই যাবে। রেস্টুরেন্টের পাশে একটা ছোট্ট টঙ দোকান খুঁজে পেলাম। একটা ব্যানসন কিনে নিয়ে ফিলিং স্টেশন থেকে হাটতে হাটতে একটু দূরে চলে এলাম। সিগারেট ছাড়লেও অভ্যাসবশত লাইটারটা সাথেই রাখি। সিগারেট ধরালাম। হাটছি আমি রাস্তা ধরে।



রাতের গভিরতা কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। একটু একটু কাঁপছি আমি। শীতের আগমনী সংগীত ঠোঁটে নিয়ে নীরব মুখরতায় একে এক ঝরে পড়ছে শিশির কণা। এই অপূর্ব আয়োজনের মাঝে আমি যেন নিস্তব্ধ রাতের বুক ছিঁড়ে জেগে উঠা একটি মানুষ। মাঝে মাঝে দুই একটা দূরপাল্লার গাড়ি প্রচণ্ড গতিতে ছুটে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। রাস্তা ছেড়ে নেমে পড়লাম। রাস্তার দুই পাশ ঘন দুর্বায় ঢাকা। আমি ইচ্ছে করেই ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটছি, সিগারেট ফুঁকছি আর স্যান্ডেলের ফাক গলে ঘাসের ডগায় তির তির করে জমে উঠা কুয়াশার আদুরে ষ্পর্শ নিচ্ছি। অনেক দিন পরে কবিতা লিখতে খুব ইচ্ছে করছে আমার। আচ্ছা! কবিতা তো ভালই লিখতাম। ছেড়ে দিয়েছিলাম কেন?

হঠাৎ খেয়াল হল রাস্তার ধারে একটা ঝোপের মত অংশে কিছু জোনাকি পোকা খেলা করছে। তারা উড়তে উড়তে মাঝে মাঝে পরস্পরের কাছে চলে আসছে আবার এক ঝটকায় দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু খুব বেশি দূরে যাচ্ছেনা, ফিরে আসছে আবার খেলার মঞ্চে। লিজা একবার বলেছিল সে কখনো সামনা সামনি জোনাকি দেখেনি। তার খুব শখ জীবনে একবার জোনাকি দেখবে। আমি হাত থেকে সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দ্রুত পা চালালাম। ফিরে যাচ্ছি রেস্টুরেন্টের দিকে। লিজাকে আজ জোনাকি দেখাব। তার জীবনের খুব বড় একটা শখ পুরন করব আমি।



লিজাকে রেস্টুরেন্টে পাওয়া গেল প্রবালের পাশে। স্নিগ্ধাকে কোথাও দেখলাম না। প্রবাল লিজার হাতটা উল্টে ধরে দেখছে আর কিছু একটা বলছে। যদিও জানি প্রবাল টুক টাক হাত দেখতে পারে, জ্যোতিষী বিদ্যা নিয়ে ঘাটাঘাটি করে তারপরও রাগে আমার সমস্ত শরীর জ্বলে উঠল। কিন্তু চেহারায় শান্ত একটা ভাব ধরে রাখলাম।

লিজার কাছে এসে বললাম, “লিজা তোমাকে এমন একটা জিনিস দেখাব যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না”।

লিজা আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, “কি জিনিস?”

“সেটা দেখলেই বুঝবে। সারপ্রাইজ। উঠে এস দেখাব তোমাকে”।

“কোথায়?”

“ঐ তো, রাস্তার উলটা পাশে। গেলেই দেখবে”।

“চল সবাই মিলে যাই”। লিজা বলে উঠল।

লিজা “সবাই” বলতে আসলে প্রবালের কথা বুঝিয়েছে সেটা বুঝতে আমার সমস্যা হলনা। আমার চোয়ালদুটো শক্ত হয়ে উঠল। বললাম, “সবাই গেলে সারপ্রাইজটা আর থাকবে না। এক্ষুনি এস, দেরি হয়ে যাচ্ছে”।

লিজা মনে হল নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়াল। প্রবালের হয়ত সাথে আসার ইচ্ছে ছিল কিন্তু আমার সামনে সে কথা বলার সাহস তার নেই।



এত রাতে আমার সাথে নির্জন রাস্তায় হাঁটতে লিজা একটু অস্বস্তি বোধ করছে। অনেকটা পথ হেঁটে এসে তাকে যেখানটায় জোনাকি দেখেছি সেখানে নিয়ে এলাম। কোথায় জোনাকি? ঝোপটা এক্কেবারে শুন্য মনে হচ্ছে। এদিকে ভোর হতে শুরু করেছে। লিজা বিরক্ত কণ্ঠে বলল, “কোথায় তোমার সারপ্রাইজ”?

আমি বেকুবের মত তাকিয়ে থাকলাম। শেষ পর্যন্ত প্রকৃতিও আমার সাথে রসিকতা শুরু করল। নাকি আমি একটু আগে ভুল দেখেছি? “এখানেই তো ছিল!”



লিজা চলে যেতে পা বাড়াচ্ছে, আমি ঝোপটা হাত দিয়ে নাড়া দিলাম। সাথে সাথে বেরিয়ে এল একগুচ্ছ জোনাকি পোকা। লিজা প্রথমে ছোট আকারের মিটি মিটি জ্বলতে ও নিভতে থাকা আলো দেখে ঘাবড়িয়ে গেল। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড বাদেই আবিষ্কার করল ওগুলো জোনাকি। লিজার চোখমুখ থেকে আনন্দের স্ফুরণ। সে হাত বাড়িয়ে জোনাকি ধরার চেষ্টা করতে থাকল। ভোর হব হব করছে, রাতের আকাশ থেকে কালিমা মুছে যাচ্ছে। আমাদের চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে কিছু রাতজাগা জোনাকি। পায়ের নিচে মনে হচ্ছে নব কুয়াশার আলিঙ্গন পেয়ে যৌবনবতী হয়ে উঠেছে ঘাসগুলো। টের পাচ্ছি শিশিরভেজা ঘাসের ষ্পর্শে আন্দোলিত হচ্ছে আমার চেতনার রুদ্ধ বাতায়ন। আমি মুহূর্তটি চিনলাম। এটাই একমাত্র সুযোগ মনের ভেতর জমে থাকা কথাটি বলে দেয়ার। অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলাম, “তোমাকে ভালবাসি লিজা”!

লিজা সম্ভবত কথাটি বুঝতে পারেনি। আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল সে। আমি আবার উচ্চারন করলাম, “আমি তোমাকে ভালবাসি লিজা। অনেক অনেক বেশি ভালবাসি”।

লিজা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল। ওকি এখন আবেগে কেঁদে ফেলবে?



একটা রোম্যান্টিক মুভিতে দেখেছিলাম ছেলেটি একগুচ্ছ লাল গোলাপ এনে মেয়েটির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, “আমি তোমায় ভালবাসি”।

মেয়েটি সে কথা শুনে আবেগে কেঁদে ফেলে।

মেয়েটির কান্না দেখে ছেলেটি তার দেয়া ফুলগুলো ফিরিয়ে নেয়। বলে, “আমি তোমাকে আর কখনো ভালবাসার কথা বলব না। তোমার চোখের অশ্রুর কারন আমি হতে চাইনা”।

মেয়েটি কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলে ওঠে, “আমি সারাজীবন তোমার মুখে এভাবে ভালবাসার কথা শুনে কাঁদতে চাই”।

তারপর তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল।

একটা সুখের দৃশ্য, অথচ পাত্র পাত্রীর চোখে কান্নার জল। জীবনে আমি কখনো এত চমৎকার রোম্যান্টিক দৃশ্য দেখিনি। আমার মত কাঠখোট্টা ছেলেও আবেগে কেঁদে ফেলেছিল।



লিজা অবশ্য কাঁদল না। সে শুধু বলল, “তুমি কি ঠাট্টা করছ আজহার?”

আমি এইরকম একটা প্রশ্ন আসবে বুঝিনি। বললাম, “এক বর্ণও ঠাট্টা নয়, তোমাকে আমি ভালবাসি। অনেক দিন ধরে কথাটা বলার সুযোগ খুজছিলাম। এই রকম মুহূর্ত আর আসবে কিনা আমি জানিনা, তাই বলে দিলাম”।

“কিন্তু আমি তোমাকে সব সময় বন্ধু ভেবেছি আজহার”।

“আমি জানি। কিন্তু আমি চাই বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু হতে”।

“সেটা সম্ভব নয়”।

“কেন সম্ভব নয় লিজা?” আমার কণ্ঠের উত্তাপটুকু স্পষ্ট টের পাওয়া গেল।

লিজা একটু ভয়ে ভয়ে তাকাল আমার দিকে। বলল, “আমি অন্য একজনকে পছন্দ করি”।



এক মুহূর্তে আমার ভেতরকার কাব্যিক অনুভূতিগুলো শূন্যে মিলিয়ে গেল। কবির স্থানে যায়গা করে নিয়েছে এক আদিম পশু। আমি হুংকার দিয়ে উঠলাম যেন, “কে সে? ঐ বেজন্মার বাচ্চা প্রবাল?”

“ছিঃ আজহার। তুমি এত নীচ!”

মাথায় রক্ত উঠে গেছে আমার। কি বলছি নিজেও জানিনা। “খুন করে ফেলব আমি জানোয়ারের বাচ্চাকে”।

“আজহার! আমি তোমাকে একটা ভাল ছেলে বলে জানতাম”।

আমি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছি না। সমস্ত শরীর কাঁপছে প্রচণ্ড রাগে। এই মুহূর্তে আমার মাঝে ক্রোধের যে আগুন জ্বলে উঠেছে তার সামান্য অংশই সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে যথেষ্ট। লিজা ভয় পেয়ে গেল। “আমি রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি” বলে উলটো ঘুরে পা বাড়াল।

আমি বললাম, “এক চুলও এগোবে না লিজা! আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে হবে তোমাকে”।

লিজার মধ্যে তখন আতঙ্ক ভর করেছে তখন। সে আস্তে করে বলল, “কি প্রশ্ন?”

“সত্যি করে বল, বাসে তুমি আমাকে এভয়েড করছিলে কেন? এটা কি প্রবাল শিখিয়ে দিয়েছিল?”

“না। আমার মনে হচ্ছিল তুমি আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছ। আর যেন দুর্বল না হও সেজন্য অমনটা করেছি আমি”।

“আর এতদিন আমার সাথে বলা কথা? হাসি আনন্দের মুহূর্ত? ছোট ছোট ব্যাথাগুলো শেয়ার করা? এগুলো কেন করেছিলে?”

“বন্ধু ভেবে করেছি। তুমি যে এত কিছু ভেবে বসবে আমি বুঝিনি”। লিজা আবার পা বাড়াল।



আমি তখন প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছি। রাগেই এই পর্যায়ে আমার পক্ষে লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয় না। “দাঁড়াও লিজা। আমার ভালবাসার মূল্য তোমাকে দিতে হবে লিজা। এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র আমি নই। এভাবে আমাকে নিঃস্ব করে তুমি চলে যেতে পারবে না। ঐ বেঈমান প্রবালকে আমি এত সহজে জিতে যেতে দেবনা”।

লিজা হাটতে থাকল।

“লিজা দাঁড়াও বলছি”!

লিজা এবার দৌড় দিল।

পিছন থেকে আমি চিৎকার করলাম, “লিজা দাঁড়াও, আমার কথা এখনও শেষ হয়ে যায়নি”!

হঠাৎ বিপত্তিটা ঘটল। লিজা শিশির ভেজা ঘাসে পা পিছলে পড়ে গেল। রাস্তার পাশে গভীর খাঁদ। লিজা গড়াতে গড়াতে চলে যাচ্ছে খাঁদের গভীরে...



***



পরের একটা ঘণ্টা কীভাবে কেটেছে তা বিষদ বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। লিজাকে কোনমতে খাঁদ থেকে তুলে আনলাম। সে তখন অচেতন, সম্ভবত পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছে। এই অবস্থায় বাসের কাছে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারছিনা। ওখানে গেলে সবাই কিছু একটা সন্দেহ করে বসতে পারে। আমি দ্রুত তার নিস্তেজ দেহটা পাজকলা করে তুলে নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটা গাড়ি থামালাম। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল যে একটা প্রাইভেট কার পাওয়া গেল, একজন মানুষ ড্রাইভ করে আসছিল। গাড়িটা থামিয়ে তাকে বুঝিয়ে বলতেই আমাদের তিনি নিয়ে এলেন একটা ফার্মেসি কাম ক্লিনিকে। জায়গাটা কোথায় আমি সঠিক বলতে পারব না।

সেখানে নিয়ে যেতেই ওরা লিজাকে একটা বেডে শুইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করল। তাড়াহুড়োয় লিজার হ্যান্ড ব্যাগটা আনা হয়নি, রাস্তায় পড়ে আছে। আমার মোবাইলেও চার্জ নেই যে কারো সাথে যোগাযোগ করব। বাসের কাছে ফিরে যাওয়ারও কোন উপায় নেই। লিজাকে এখানে রেখে তো আমি চলে যেতে পারিনা। কিন্তু বাস তো খুব বেশিক্ষন আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে না। বড়জোর এক ঘণ্টা! এর মধ্যে যদি লিজার জ্ঞান না ফেরে তাহলে আমরা বাসের কাছে যেতে পারব না। ওরা বাস নিয়ে চলে যাবে! কমলের জন্য তো মাত্র ১০ মিনিট ছিল। সিডিউল খুব টাইট। বাসটা এখন গিয়ে কক্সবাজারে হোটেল শৈবালে থাকবে। ওখানে একদিন থাকার পুরো টিম সেন্ট মারটিনের দিকে যাত্রা করবে।



এর মধ্যে মোবাইলের চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম, স্নিগ্ধার সাথে যোগাযোগ করলাম। তাকে বুঝিয়ে বললাম ঘটনাটা, শুধু আমার প্রপোজ করার অংশটা বাদে। জানলাম বাস রওনা দিয়েছে আমাদের ফেলে। আমি কথা দিলাম লিজার জ্ঞান ফিরলে যত দ্রুত সম্ভব অন্য বাসে করে আমরা হোটেল শৈবালে পৌঁছে যাব।



লিজার জ্ঞান ফিরে এল ঘণ্টা তিনেক পর। জ্ঞান ফেরার পর সে আমার সাথে আর কোন কথাই বলল না আর। তাকে বুঝিয়ে বললাম কি ঘটেছে। অন্য একটা বাসে চড়ে আমরা কক্সবাজার গেলাম। সেখান থেকে রিক্সা করে রওনা দিলাম হটেল শৈবালের দিকে। সারাটা পথ লিজার সাথে আর একটি কথাও বলিনি আমি। মেয়েটির কাছ থেকে একটু আগেই প্রত্তাখ্যাত হয়েছি আমি। কথা বলব কোন মুখে?



ভালবাসার মানুষের সামনে "ভালবাসি" শব্দটি উচ্চারনের পর যারা প্রত্যাখ্যাত হয়, তাদেরকে দুই দলে বিভক্ত করা যায়।



একদলের কাছে "ভালবাসি" শব্দটি বুকের ওপর চেপে বসা জগদ্দল পাথরের মত। যতক্ষণ শব্দটি বেরিয়ে না আসে, দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড় হয়। দুটো শক্ত হাত যেন তার গলায় সাঁড়াশির মত চেপে বসে। প্রতিমুহূর্তে নিষ্পেষিত হতে হতে ক্লান্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়। শব্দটি বেরিয়ে যেতেই যেন ভারী পাথরটির হাত থেকে তাদের নিষ্কৃতি মেলে। শুধু মনে হয়, "এই পৃথিবীতে আমার চেয়ে সুখী মানুষ আর কেউ নেই, আমি আমার ভালবাসার কথাটা জানিয়ে দিতে পেরেছি"।



আর একদল থাকে "ভালবাসি" শব্দটি যাদের কাছে ঝোলার ভেতর লুকিয়ে রাখা শেষ সম্পদের মত। শব্দটি উগড়ে দিতেই তারা নিঃস্ব-রিক্ত-অসহায় হয়ে যায়। নিজেকে তখন মনে হয় রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরের চেয়েও অধম। মুখে হাসি ধরে রাখলেও, হৃদয়ের ভেতরের শুন্যতাটুকু খুব বেশি কষ্ট দেয়। রঙ বেরঙের পোশাক পরে বসে থেকেও সে জানে অন্তত একজন মানুষের সামনে সে দিগম্বর উন্মাদের সমপর্যায়ের। শুধু আফসোস হয় "কেন বলে দিলাম? ভালবাসাটুকু নিজের মাঝেই কেন ধরে রাখলাম না?"



আমি এই দ্বিতীয়দলের মানুষ। ভালবাসার কথা জানিয়ে দিয়ে আমি মেয়েটির কাছে নিজেকে উপহাসের পাত্রতে পরিনত করেছি। মাটি ভেদ করে মুখটা লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে খুব।



****



হোটেল শৈবালের বাইরে আমাদের বাস দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে বাস দেখেই আনন্দে উদ্ভাসিত হল লিজার মুখ। সে রিক্সা থেকে নেমেই দৌড়ে গেল। প্রবাল স্নিগ্ধা আবিদ ভাই সহ আরও অনেকেই হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে ছিল। লিজা দৌড়ে গিয়ে স্নিগ্ধাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর স্নিগ্ধাকে ছেড়ে সে প্রবালের হাত ধরল। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসল। চোখে চোখে কথা হল অনেক। মাঝে মাঝে এমন কেন হয়? কেউ না চাইতেই দুহাত ভরে পায় আর কেউ সারাজীবন তপস্যা করেও খালি হাতে ফেরে!



লিজাকে ওদের সাথে রেখে আমি এক পাশে চলে এলাম। “কি হয়েছিল”, “কেন হয়েছিল”, “কীভাবে হয়েছিল”- এমন একগাদা প্রশ্ন শুনতে হবে। এখনই রুমে গিয়ে একটু বিশ্রাম না নিলে আর চলছে না। কিন্তু স্নিগ্ধা আমাকে পাকড়াও করল। আমাকে ডেকে নিয়ে গেল একটু আড়ালে।

আমি বললাম, “আমি এখন কিচ্ছু বলতে চাচ্ছিনা স্নিগ্ধা। সবটুকু তোকে পরে বুঝিয়ে বলব”।

স্নিগ্ধা বলল, “আমি লিজার ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছিনা আজহার”।

“তাহলে?”

“আমি জানতে চাই কমলের ব্যাপারে”।

“কমল? তার ব্যাপারে আমি কি বলব?”

“কমলকে আহত অবস্থায় কুমিল্লার সেই ফিলিং স্টেশনের পেছনে কয়েকটা গাছের আড়ালে পাওয়া গেছে। তার শরীরের নানা যায়গায় আঘাতের চিহ্ন। কেউ ভারী পাথর বা ইট দিয়ে তার মাথা ও মুখে আঘাত করেছে। চোখের আশে পাশে কাঁটা দাগ। কেউ যেন চোখ দুটো উপড়ে ফেলতে চাইছিল”।

“ব্যাপারটা দুঃখজনক”। আমি মাথা নেড়ে বললাম।

স্নিগ্ধা শক্ত করে আমার একটা হাত চেপে ধরল, “আমি জানি কাজটা তুই করেছিস”।

“কি বলছিস তুই?” আমার কণ্ঠে নির্ভেজাল বিস্ময়।

স্নিগ্ধা আমার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর এই দৃষ্টির সামনে আমি তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। মাথা নিচু করে ফেললাম। সে বলল, “আজহার। আমার দিকে তাকা”।

আমি তাকালাম না।

“এই কাজটা তুই করেছিস তাইনা?”

মাথা নিচু করেই বললাম “কোন কাজ?”

“না বোঝার ভান করিস না। তুই নিজেকে যতটা ভাল অভিনেতা ভাবিস ততটা ভাল তুই না! আমার কাছে স্বীকার কর। কমলকে তুই মেরেছিস”?

“আমি কাউকে মারিনি”।

“আমার কাছে লুকনোর চেষ্টা করিস না আজহার। তোকে আমার চেয়ে ভাল করে কেউ চিনেনা। কমলের দিকে তাকানর সময় তোর চোখের দৃষ্টি আমি দেখেছি। স্পষ্ট প্রতিহিংসা। আমি জানতাম তুই খারাপ কিছু একটা করে বসতে পারিস”।

“কেন মারব আমি তাকে?”

“কারন সে বাজে ভাবে তাকাচ্ছিল লিজার দিকে। সেটা তোর সহ্য হয়নি। তুই একটা সিক!”

“আমি সিক? তুইও এই কথা বলতে পারলি স্নিগ্ধা?”

“কেন বলব না? আমি জানি তোর মধ্যে এক ধরনের ইনফেরিঅরিটি কমপ্লেক্স কাজ করে। যেটা সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডারের পর্যায়ে পড়ে। নিজেকে ছোট ভাবতে ভাল লাগেনা তোর। যারা সেটা তোকে ফিল করায় তার ক্ষতি করিস তুই। এক ফাংশনে তোকে র‍্যাগিং করেছিল বলে তুই হামিদ ভাই আর তার বন্ধুদের পিটিয়েছিলি লোক লাগিয়ে”।

“সেটা ডিফারেন্ট ইস্যু...”

“না ডিফারেন্ট না”। স্নিগ্ধা আমাকে থামিয়ে দিল। “এমন আরও অনেক উদাহারন দিতে পারি আমি। কয়টা শুনতে চাস তুই? এই সবই প্রমান করে রেগে গেলে তুই বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাস। তখন তোর পক্ষে যেকোনো অঘটন ঘটানো সম্ভব”।

আমি চুপ করে থাকলাম।

“আমরা বন্ধুরা মিলে ঠিক করেছিলাম তোর ভেতরের এই কমপ্লেক্স দূর করব। আর লিজার মত এমন একটা মেয়েকে যদি তুই জয় করতে পারিস তাহলে তোর মনে হবে তুই ফেলনা না, তুই ছোট না, তুই ও মানুষ। কিন্তু মেয়েটিকে পাওয়ার জন্য তুই যে এত নিচে নামতে পারবি সেটা আমার ধারনার অতীত ছিল”।

আমি বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছিনা।

“তুই জানিস কেন রাতুল আসেনি এই
 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on October 22, 2013 21:21

October 14, 2013

ঈদ স্পেশাল রম্যগল্পঃ জলিলের বাস ভ্রমন

আমি জলিল।



না না! জলিল নাম শুনিতেই যে জলিলের চিত্র আপনাদের চোখের সামনে ভাসিয়া উঠিছে, আমি সেই জলিল না। আমার পুরা নাম জলিল খন্দকার। আমি আসম্ভবকে সম্ভব করিতে মোটেও পারদর্শী নই। বরং সম্ভব কাজগুলিও আমার কাছে অসম্ভব বলিয়া মনে হয়।



পাবলিক বাসে চড়িবার উদ্দেশ্যে ঘণ্টা খানেক যাবত গুলিস্তানের মোড়ে দাঁড়াইয়া আছি, বাসের দেখা মিলিতেছে না। মনটা অত্যধিক খারাপ হইয়া আছে। তাই ভোর বেলা বাড়ি হইতে বাহির হইয়াছি মগবাজার যাইব বলিয়া। দাঁড়ান, দাঁড়ান! মগবাজার যাইবার কথা শুনিয়া আপনাদের ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি দেখা যাইতেছে কেন? আমার চরিত্র লইয়া খারাপ কিছু ভাবিয়া বসিয়েন না। মগবাজারে আমার বন্ধু মাহতাব থাকে। মন খারাপ হইলে আমি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করি। অচিরেই মন ভাল হইয়া যায়।



আপনাদের হয়ত ভাবিতেছেন মাহতাব রসিক মানুষ। হাসি তামাশা দ্বারা মন ভাল করিতে উস্তাদ। প্রকৃত পক্ষে তেমন কিচ্ছু নহে। বন্ধু মাহতাব হইতেছে পৃথিবীর সবচাইতে দুঃখী মানুষের একজন। সমস্ত পৃথিবীর মানুষের দুঃখ এক করিলে তাহার দুঃখ অপেক্ষা কম না হইলেও সমান হইবে। তাই আমার মনখানা খারাপ হইলেই তাহার নিকট গিয়া উপস্থিত হই। তাহার দুঃখের কথা শুনিলে আমার মন ভাল হইয়া যায়। মনে হয় জগতে আমার চাইতেও দুঃখী মানুষ আছে! এই তো সেবার জুলেখার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হইবার পর মনের দুঃখে মাহতাবের কাছে গেলাম। মাহতাব শুনাইল আরও কষ্টের এক করুন কাহিনী...



মাহতাব ইডেন কলেজের এক ললনার সহিত হৃদয়ঘটিত সম্পর্কে জড়াইয়া গিয়াছিল। কন্যার সহিত ফেসবুকে পরিচয় মোবাইলে প্রেম। অবশেষে একদিন বিকেলে তাহারা শুভদিন বিবেচনা করিয়া দেখা করিবার প্লান করিয়াছিল।



যথাসময়ে দেখা হইল কিন্তু দেখা হইতেই ললনা বলিয়া উঠিল, “তুমি তো শুকনা! প্রেম করবা কীভাবে?”



এই কথা বলিবার পর ললনা তাহাকে ফেলিয়া চলিয়া গেছে, শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পুনরায় তাহাকে বিরক্ত করিলে লেডি গুন্ডা দ্বারা মাইর খাওয়ানোর হুমকি দিয়াছে!



প্রেম করিতে মোটা হওয়া লাগে ইহা আমার ধারণাতীত ছিল! বন্ধু মাহতাব হাপুশ নয়নে কাঁদিতেছিল এই কাহিনী বলিবার সময় যাহা দেখিয়া আমি জুলেখার শোক ভুলিয়া গিয়াছিলাম। তাইত মন খারাপ হইতেই তাহার খোঁজে যাইতেছি। জানি এবারো মাহতাব আমাকে হতাশ করিবে না।



***



পাবলিক বাস চলিয়া আসিছে। বাসে উঠিবার নিমিত্তে দাঁড়াইয়া থাকা যাত্রীগণের সহিত যুদ্ধ করিবার লক্ষে প্রস্তুতি গ্রহন করিলাম। অনেক কষ্ট করিয়া, দুই চারশ গ্রাম ঘাম ঝড়াইয়া, কোমরের ধাক্কায় দুই চার জনকে কুপোকাত করিয়া অবশেষে পাবলিক বাসে চড়িতে সমর্থ হইলাম। বাসের হ্যান্ডেল একখান পাকাইয়া ধরিয়া মানুষের ভিড়ে “মানুষিক চাপে” পিষ্ট হইয়া যখন প্রানান্ত অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছে, তখনই খেয়াল হইল সম্মুখের আসনে একখানা ছোট খাট হস্তি বসিয়া রহিয়াছে। মনুষ্যআসনে হস্তী বসিয়া থাকিবার হেতু বুঝিয়া পাইলাম না। অবশ্য দৃষ্টিশক্তির ক্রমাগত কসরত চালাইয়া ঠাহর করিলাম সম্মুখের আসনে বসিয়া থাকা হস্তীখানি প্রকৃতরুপে হস্তী নয়, উহা একখান মানবশিশু! বোধকরি তাহাকে মানব শিশু অপেক্ষা হস্তিশিশু নামে সম্বোধন করাই শ্রেয় হইবে।



হস্তীশিশুর পাশেই দেখিলাম দশাসই চেহারার এক পূর্ণাঙ্গ হস্তীও অবস্থান করিতেছে। যেমন পিতা, তাহার তেমন সুপুত্র দেখিয়া বাস সুদ্ধ লোকে “ওরে বাবারে!”, “এইটা আমি কি দেখলাম?”, “কেউ আমারে মাইরালা”, “খোদা আমারে উডায় লও” ইত্যাদি বাক্য দ্বারা উহাদের সাধুবাদ জানাইতে লাগিল।



হস্তীদ্বয় অতি কষ্টে তিনজনের সিটে দুজনে বসিয়া রহিছে। ইহার পরও তাহাদের আরাম করিয়া বসিতে কষ্ট হইতেছিল। বলাবাহুল্য তাহাদের এহেন কষ্ট দেখিয়া কেউ তাহাদের চাপিয়া বসিয়া আর একজনের বসার যায়গা দেওয়ার কথা বলিতে পারিলেন না, অথবা বলিতে সাহস পাইলেন না!



খানিক বাদে লক্ষ করিলাম বাসে মধ্যে মশক বাহিনীর খালাত ভাই একখান মাছির উদ্ভব হইল। মাছিখানা হস্তীশিশুর আশে পাশে ভন ভন রবে ঘুরিতে লাগিল। হস্তী শিশু বিরক্ত হইয়া মাছিটা পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিল। তাহাদের সম্মুখের আসনে একজন মুরাদ(মাঝবয়সী) টাকলা সিটে হেলান দিয়া ঘুমাইয়া ছিলেন। হঠাৎ মাছিখানা তাহার স্টেডিয়ামরুপী মস্তকে বসিয়া গেল। হস্তী শিশু আচমকা চপেটাঘাতে তাহার মাস্তিস্কের সাথে মাছিটিকে লেপটাইয়া দিল। বাচ্চা হাতির এহেন ত্বরিতকর্ম দেখিয়া আমি বিস্ময়ে প্রায় অজ্ঞান হইয়া যাইতেছিলাম।



ওদিকে মুরাদ টাকলা তাহার টাকে এইরূপ মোক্ষম আঘাত খাইয়া “রানা প্লাজা ভাইঙ্গা পড়ছে রে” বলিয়া ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিলেন! সেকেন্ড পাঁচেক কাটিবার পর বুঝিতে পারিলেন তাহার স্টেডিয়ামে কেহ ছক্কা পিটাইয়াছে! চক্ষু গরম করিয়া পিছনে তাকাইলেন, উদ্দেশ্য চপেটাঘাতকারীকে কিছু মুখরোচক গালি গালাজে ভস্ম করিয়া দিবেন।



কিন্তু হস্তীশিশু আর তাহার হস্তী বাপকে দেখিয়া তিনি কাচুমাচু হইয়া কহিলেন, “বাবু! খেলাধুলা করছ? ভাল তো! খেল খেল!”



মুরাদ টাকলা চিরতার পানি খাইয়াছেন এমন ভাব করিয়া পুনরায় তাহার সিটে বসিয়া পরিলেন। এখন আর পিছনে হেলান দিতেছেন না। তিনি জানেন অমন চপেটাঘাত আর একখান পরিলে আর আপন পদ দ্বারা হাঁটিয়া বাড়ি ফিরিতে পারিবেন না।



এক্ষনে আমি কাণ্ড দেখিয়া হাসিতে ছিলাম। হঠাৎ খেয়াল হইল একখান মাছি আমার মুখের সামনে দিয়া আপন সুখে গুনগুন করিয়া উড়িয়া বেড়াইতেছে। হস্তীশিশু আওয়াজ লক্ষ করিয়া অগ্নি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাইল। ভয়ে তখন আমা আত্মারাম খাঁচাছাড়া হইবার যোগাড়!



***



পাশ থেকে একজন লোক বলিয়া উঠিল,” ভাই দেখেন! কতক্ষন ধইরা খাঁড়াইয়া আছে!”

আমি আতঙ্কিত চোখের তাহার দিকে তাকাইলাম, “কি খাঁড়াইয়া আছে ভাইজান?”

“বাসটা। সিগ্ন্যাল পড়েনাই কিছুনা, হুদাই খাঁড়াইয়া আছে!”

আমি হাফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। “যাক! অন্য কিছু খাঁড়া হয় নাই”।



বাস খানা বিজয়নগর মোড়ে আসিয়া অযথাই দাঁড়াইয়া রহিল, যদি আরও কিছু যাত্রী উঠানো যায়! এমনিতেই বাসের ভিতরে দম ফেলিবার উপায় পাইতেছি না, ডাইভার আরও যাত্রী উঠাইতে ইচ্ছুক। মনে হইতেছিল ড্রাইভারকে একটা কইন্না দেই ধরে!



বসিয়া থাকিতে থাকিতে অতিষ্ঠ হইয়া উঠা যাত্রীগনের কেউ একজন হঠাৎ তড়াক করিয়া দাঁড়াইয়া কইয়া উঠিল। “ঐ ড্রাইভার! গাড়ি ছাড়বি নাকি দিমু কানের নিচে একটা?”



এহেন বাক্যবাণ পাবলিক বাসে নিত্যদিনের ব্যাপার। অবাক হইবার কিছু নাই। তথাপি বাস সুদ্ধ লোক অবাক হইয়া হুমকি প্রদানকারীর দিকে উৎসুক চোখে তাকাইয়া রহিল। কারন এহেন হুমকি দেওয়া মানুষটি কার্যত একজন মহিলা। আমি তাকাইয়া দেখিলাম আমার মায়ের বয়সী খালার মত দেখতে একজন মহিলা চোখ গরম করিয়া অঙ্গুলি উচা করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। কিঞ্চিৎ ভীমরি খাইয়া গেলাম!



অতি উৎসাহী যাত্রী গনের একজন আবার কহিয়া উঠিল, “ও খালা! ড্রাইভারের কানের নিচে কি দিবা? থাবড়া না উশটা?”

খালামনি বত্রিশ দণ্ত প্রদর্শনপূর্বক কহিল, “কিছুই না। ওরে চুম্মা দিমু!”



বলা বাহুল্য এই কথা শুনিবা মাত্রই ড্রাইভার ফুল স্পীডে গাড়ি ছুটাইল। কানের নিজে খালামনির একটা থাবড়া হয়ত তাহার সহ্য হইবে কিন্তু চুম্মা সহ্য হইবার নয়!



***



আমার মধ্যে একটু ঝিমানি ভাব চলিয়া আসিল হঠাৎ শুনিলাম কেউ একজন পিছন হইতে প্রশ্ন করিতেছে, “ভাই সানি লিওন?” আমি ঘাবড়াইয়া গেলাম! কসম কাটিয়া কহিতেছি সানি লিওনের সাথে আমার চেহারা বা শারীরিক বৈশিষ্ট্যে কোনরূপ সাদৃশ্য খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না!



“ভাই সাইড দিবেন?” ওহ! এক্ষনে প্রশ্নখানা পরিষ্কার ভাবে বুঝিলাম। তাকাইয়া দেখি দানবাকার এক দৈত্য দাঁড়াইয়া আছে ঠিক পেছনেই। “দানবাকার দৈত্য” শব্দে উপমার ভুল প্রয়োগ বা দ্বিত্বতা সংক্রান্ত ব্যাকরণগত ভুল কেউ খুঁজিতে যাইয়েন না। উহার শারীরিক অবয়বের বর্ণনা দিতে ইহা হইতে উত্তম উপমা খুজিয়া পাইলাম না। আমি পড়িমরি করিয়া সাইড দিলাম।



দানবাকার দৈত্য সামনে আগাইয়া আসিয়া কহিল, “আমজাদ ভাই, ভাল আছেন?”

আমজাদ সম্বোধন ছুঁড়েছেন তিনি হস্তী পিতাকে লক্ষ করিয়া। হস্তীপিতা উঠিয়া দাঁড়াইলেন। “আহারে, খলিল ভাই যে!”

দুই দানবে কোলাকোলি করিতে লাগিলেন।



দানবে দানবে দাপাদাপি শুরু হইল যেন! আমাকে একবার জানোয়ার নামরুপী এক ব্লগার বাজে কথা কহিয়াছিলেন, দীর্ঘদিন যাবত তাহার উপর রাগিয়া আছি আমি। তাহাকে মনে মনে দুই দানবের মাঝে দাড় করাইয়া দিলাম! “মর-মট-মরাট!” আহা! হাড় ভাঙ্গিবার শব্দ স্পষ্ট শুনিতে পাইলাম যেন! “মট্টর!” এইবার ফাটিয়াছে মাথার খুলি!



কোলাকোলি অর্থাৎ দাপাদাপি শেষ হইলে আমজাদ হস্তী কহিল, “ভাই আছি ভালই। ছেলেটা ভাল নাই”।

আমার চোখ উলটাইবার উপক্রম! “এই বাচ্চা হাতি ভাল নাই? খানিক আগে চপেটাঘাত দ্বারা একজনকে খুন করিয়া ফেলেছিল প্রায়!”

খলিল দৈত্য বলিল, “কি হয়েছে?”

“কিচ্ছু খাইতে চায়না! ওর মা কত কিছু খাওয়াতে চেষ্টা করে সারাদিন”!

আমার অবস্থা এই কথা শুনিয়া কি হইল তাহা আর না বলিলাম। আপনাদের অবস্থা দ্বারাই আমার অবস্থা অনুমান করিয়া লন!

খলিল দৈত্য কহিল, “আহারে! এই জন্যই তো বেচারা শুকিয়ে গেছে!”

আমি কহিলাম আপন মনে, “হে খোদা, উপর থেইকা দড়ি ফালাও আমি বাইয়া উইঠা জাইগা!”

আমজাদ হস্তী কহিল, “খাওয়ার মধ্যে সারাদিন খালি চিকেন খায়! আর কিছু খায়না!”

এইবার হাসিলাম! “হে হস্তী শিশু! এইবার না তোর বাহুল্য মাংশের রহস্য বুঝিলাম! আকাম যা করার ঐ চিকেনই করিয়াছে! মাহতাবকে বলিতে হইবে অতিরিক্ত চিকেন ভক্ষন করিতে, তাহা হইলে তাহার শুকনা হইবার বদনাম ঘুচিয়া যাইবে”।



হঠাৎ সেই মাছিখানা আবার আমার নাকের কাছে ঘুরিতে লাগিল! হস্তি শিশুর অতি আগ্রহ নিয়া আমার নাকের দিকে তাকাইয়া থাকা দেখিয়া ভয়ে আমার আত্তারাম খাঁচাছাড়া হইতে চাইল।



অবশ্য মানীর মান আল্লায় রাখে! বাস ততক্ষনে কাকরাইল মোড়ে পৌঁছাইয়া গেছে। এক গাঁদা বসিয়া থাকা যাত্রী নামিয়া পড়িতেই দাঁড়াইয়া থাকা যাত্রী গনের মধ্যে বসার জন্য হুটোপুটি শুরু হইল। আমি হস্তীগণের নিকট হইতে দূরে একখানা সিট দখল করিয়া লইলাম। আমার সামনের দুখানা সিট ও পাশের সিট খালি পড়িয়া রইল। মনের দুঃখে একখান দুঃখে ভরা গান ধরিলাম, আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে...



***



বাস যতক্ষণে শান্তিনগর মোড়ে পৌছাইছে আমি ততক্ষনে আবিস্কার করিয়াছি আমার সিটখানির গদির অভ্যন্তরে তারকাটা জাতীয় কিছু একটা রহিয়াছে যাহা ক্রমাগত আমার নিতম্বকে খোঁচায় খোঁচায় জর্জরিত করিতেছে। আমি নড়া চড়া করিয়া মানাইয়া লওয়ার চেষ্টা রত। ভাবিতেছি সিট খানা বদল করিব এমন সময় এক জব্বর কাণ্ড ঘটিল। শান্তিনগর মোড় হইতে বাসে একজন হুরপরী উঠিলেন।



আমি কিঞ্চিৎ চিন্তিত হইলাম। এহেন স্থানে স্বর্গের হুরপরীর দেখা মিলিবার হেতু কি হইতে পারে? আমি কি মৃত্যুবরণ করিয়াছি? কিন্তু আমার মত বদের তো স্বর্গ লাভ করিবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই! খানিক বাদে হুরপরীর পেছন পেছন বাসের দরজায় আমার ভাইয়ের বড় ভাইয়ের বয়সী বাপের মত দেখতে এক হোঁৎকা বালকের উদয় হইতে বুঝিলাম আমি স্বর্গে যাই নাই, স্বর্গ হইতে একখান হুরপরী মর্তে নামিয়া আসিছে।



বাসে আমার পাশের সিট খানা তখনও খালি রহিয়াছে। আমি জানালার দিকে একটু চাপিয়া বসিয়া সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিলাম। মনে আশা জাগিছে হয়ত এই হুরপরী আমার পাশেই বসিবে। বুঝ ক্ষমতা হওয়ার পর অর্থাৎ এক বছর বয়স হইতে দেখিয়া আসিতেছি, সাধারণত হুরপরীরা আমার পাশে বসিতে পছন্দ করে। প্রতিবারই তাহাদের সহিত কিঞ্চিৎ লুলামি করিয়া আমি সখ্যতা গড়িয়া লই। আমার জিভ হইতে ততক্ষনে “দি তেঁতুল থিওরি অফ লালা” অনুযায়ী লালা নির্গত হইতেছে। তথাপি সৃষ্টি কর্তার দয়া হইল না। আনন্দের আতিশয্যে খেয়াল হয়নি আমার সামনের সিটখানাও উদোম অর্থাৎ খালি রহিয়াছে। হুরপরী ঠিক আমার সামনের সিটে বসিয়া পরিল। কিন্তু বিমর্ষ হইয়া দুদণ্ড শোক পালন করিবার ফুসরত মিলিল না। তার আগেই হোঁৎকা বালক আসিয়া আমাকে কোমরের ধাক্কায় দিয়া আরও দুই তিন ইঞ্চি যায়গা করিয়া বসিয়া পরিল।



হুরপরী অবলোকন করিয়া আমার নিতম্বের নিচের তারকাটা সমস্যার কথা ভুলিয়া গিয়াছিলাম। এক্ষনে আবার তাহার স্বাদ পাইতে লাগিলাম। সামনের আসনে হুরপরীর পানে দৃষ্টি রাখিয়া আবার বাইন মাছের মত মোচড় খাইতে লাগিলাম। হঠাৎ খেয়াল হইল হোঁৎকা বালক খানিকক্ষণ আমায় দেখে আবার আবার খানিকক্ষণ দেখে হুরপরীকে। তাহার চোখে অগ্নিদৃষ্টি দেখিয়া বুঝিলাম সে সম্ভবত আমার বাইন মাছের মত মোচড় খাওয়া আর সামনের আসনে হুরপরীর বসে থাকার মাঝে কোন যোগসূত্র আবিস্কার করিয়াছে। অগত্যা জান বাচাইবার উদ্দেশ্য নিতম্ব সমস্যা ত্যাগ করিলাম অর্থাৎ তারকাটার গুঁতো বিনা প্রতিবাদে হজম করিতে থাকিলাম।



***



বাস চলিতেছে। হুরপরীর হঠাৎ মোবাইল বাজিয়া উঠিল। আহ কি রিংটোন! “মেরে আশিকি আব তুম হি হো!” আমিও মনে মনে গাইতে লাগিলাম, “মেরে হুরপরী আব তুম হি হো!”



বাস পৌঁছাইল মৌচাকে। হুরপরী মোবাইলফোন বাহির করিয়া কাহারো সাথে ফোনালাপ শুরু করিয়াছে। “জানটুস, এইতো কাছাকাছি চলিয়া এসেছি। আর কিছুক্ষন অপেক্ষা কর লক্ষিসোনা!”

দিলে বড় চোট পাইয়া গেলাম। হুরপরীর একখান ছেলেবন্ধু আছে তাহা ছিল আমার কল্পনার অতীত। বলা বাহুল্য, আজ অবধি মোবাইল ফোনে এহেন মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনিবার সৌভাগ্য আমার হয় নাই। আমি খাড়া করিয়া... মানে কান খাড়া করিয়া তাহার বাক্যালাপ শুনিতে লাগিলাম।



এদিকে বাসের বেরসিক হেলপার চিৎকার করিতেছে, “ওই মৌচাক! মৌচাক নামেন!!” সেই কর্কশ আওয়াজে হুরপরীর ফোনালাপে সমস্যা হইতেছিল। সে অপর হাতের কনিষ্ঠা দ্বারা কানের ফুটো আটকাইয়া কথা বলিতে লাগিল। আমি মনে মনে গাল পাড়িলাম হেলপারকে, “ওরে হতচ্ছাড়া। অমন কর্কশ কণ্ঠে গলা ফাটাইয়া মৌচাক মৌচাক করিতেছিস কেন? সুন্দরী ললনার ফোনালাপ বাধাগ্রস্ত হইতেছে তাহা তুই বুঝিস না? তোর ঘরে সুন্দরী বউ নাই বলে কি সুন্দরী মেয়েদের সম্মান দিবিনা?”



পাশের হোঁৎকা পোলা ততক্ষনে ঝিমাইতে আরম্ভ করিছে। আমার গায়ে হেলান দিয়া পরিল। পাহাড়ের তলে চাঁপা পরিলে পিঁপড়ার কি অবস্থা হইতে পারে ধারনা আছে আপনাদের? আমার অবস্থা তখন তারচেয়েও ভয়াবহ!



***



বাস মৌচাক ছাড়াইয়া ওয়্যারলেস রেলগেট আসিয়া পরিছে। হোঁৎকা পোলা পড়ি মরি করিয়া উঠিয়া বাস হইতে নামিয়া গেল। আমি একটু হাফ ছাড়িবার অবকাশ পাইয়াছি। হুরপরী তখনও ফোনে কথা বলিয়া চলিছে। আহা কি মধুর কণ্ঠস্বর। শুনিয়াই মনে হয় বাহির হইয়া যায়... মানে… প্রান বাহির হইয়া যায় আর কি!

উজবুক হেলপার আবার শুরু করিল, “ওই ওয়্যারলেস নামেন, ওয়্যারলেস”।



হুরপরী আবার অপর হাতের আঙ্গুল দিয়া কানের ফুটা বুজাইয়া বলিতে লাগিল, “এইতো জান্টুস আসিয়া পরেছি। আর একটু দূরে রহিয়াছি”।



সম্ভবত অপরপ্রান্ত হইতে জিজ্ঞাসা করিল, “সেই কখন থেকে বলিতেছ কাছেই আছ, কাছেই আছ! এই মুহূর্তে কোথায় রহিয়াছ প্রানের হুরপর?”



হুরপরী কহিল “দাঁড়াও দেখিতেছি”। অতপর আশে পাশের দোকানের সাইনবোর্ড দেখিয়া সটান হইয়া দাঁড়াইয়া গেল। হেলপারের উদ্দেশ্যে কহিল, “ওই কুত্তার বাচ্চা হেলপার। বাস ওয়্যারলেস আইসা পরছে, তুই কস নাই কেন? মৌচাকে নামাইলি না কেন? শুয়োরের বাচ্চা! তোরে না কইলাম মৌচাকে আসলে বলার জন্য!”



হেলপার তো হেলপার! ড্রাইভার, আমি, হস্তীবৃন্দ এবং বাসের সকল যাত্রী অবাক হইয়া তাহার পানে তাকাইয়া রহিলাম। অমন সুন্দর মুখশ্রী হইতে এইরূপ গালি বর্ষণ হইতে পারে ইহা ভাবনার অতীত! হুরপরী অকথ্য ভাষায় ড্রাইভার আর হেলপারকে অশ্লীল সব গালি গালাজ করিতে করিতে বাস হইতে নামিয়া গেল। মনে মনে সৃষ্টি কর্তাকে ধন্যবাদ দিলাম। ভাগ্যিস ললনাকে আমার পাশে উনি বসান নি! নচেৎ স্বভাব অনুযায়ী হয়ত হুরপরীর সহিত লুলামি করিতে গিয়া উলটো গালিগালাজ শুনিয়া মান সম্মান হারাইয়া জানালা হইতে লাফাইয়া পরিয়া আত্মাহুতি দিতে হইত!



***

বাস মগবাজার পৌছাইতে আমি নামিয়া গেলাম। মাহতাবকে একটা ফোন করা দরকার। মোবাইলের উদ্দেশ্যে পকেটে হাত চালালাম! ওরে! আমি তো শ্যাষ! মোবাইল খানা কোন এক আল্লাহর বান্দা চক্ষুদান করিয়াছে! হায় হায় মানিব্যাগ কই? টাকা পয়সা যা ছিল গেছে! ঘড়িখানাও হাতে নাই! এক্ষনে কি উপায় হইবে রে??



আজকে আমার দুঃখের দিন! মাহতাব যতই দুঃখের কাহিনী শুনাক না কেন, আমার দুঃখ দূর হইবেনা। বরং আমার কাহিনী শুনিলে মাহতাব তাহার এক জীবনের সকল দুঃখ ভুলিয়া যাইতে সমর্থ হইবে!!



*****************************



সিরিয়াস গল্প লিখতে লিখতে একটা একঘেয়েমি চলে এসেছে আমার মধ্যে। ঈদ উপলক্ষে তাই একটু ভিন্ন কিছু করার প্লান ছিল। গল্পের উদ্দেশ্য একটাই আর তা হল মানুষকে হাসানো। যদি হাসাতে পেরে থাকি তাহলে খুব আনন্দিত হব।



উৎসর্গঃ বন্ধু অপু তানভীরকে <img src=

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on October 14, 2013 10:28

গুডরিডস ব্লগ

Nazim Ud Daula
এই ব্লগে নাজিম উদ দৌলার লেখা ছোট গল্পগুলো পড়তে পাওয়া যাবে।
Follow Nazim Ud Daula's blog with rss.