অপছায়া

রাত ১১টায় কলিং বেল বাজার আওয়াজ শুনে আমার ভ্রু খানিকটা কুঁচকে গেল। এত রাতে সাধারণত আমার কাছে কেউ আসেনা! আমি খাবার টেবিলে সব কিছু সাজিয়ে নিয়ে খেতে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

এই ফ্ল্যাটটা আমার দাদার কেনা। বাবা ছিলেন দাদার এক মাত্র সন্তান। দাদা মারা গেলেন, দাদি গেলেন, বাবা মাও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন- সবাই মরেছেন এই ফ্ল্যাটেই। এখন আছি আমি একা! অবশ্য সম্পূর্ণ একা কি বলা যায়?

আবার কলিং বেল বাজতেই ভাবনায় ছেঁদ পড়ল আমার। উঠে গেলাম কে এসেছে দেখতে। লুকিং গ্লাসের বাইরে দাঁড়ানো লোকটাকে তেমন চেনা যাচ্ছেনা।আমি হেঁড়ে গলায় জিজ্ঞেস করলাম, "কে? কে ওখানে?"

"আমি, নাজিম ভাই"! লোকটা উত্তর দিল।"আমি জামিল"

জামিল হায়দার! আমার অফিসের কলিগ! হুজুগে টাইপের স্বভাব, অতিরিক্ত কথা বলে! লোকটা এত রাতে আমার বাড়িতে কি মনে করে এসেছে? আমি দরজা খুলে দিলাম। মুখে সামাজিকতার হাসি ধরে রেখে বললাম, "আসুন জামিল ভাই, হঠাৎ কি মনে করে?"

জামিল হায়দার ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে উত্তর দিল, "আমার এক আত্মীয়র বাড়ি আপনাদের গলির মুখেই। ওনার কাছে একটা দরকারে এসেছি, রাতে ওখানেই থাকব। তাই ভাবলাম এক ফাকে আপনার কাছ থেকেও ঘুরে যাই"।

"ভাল করেছেন। আমি খেতে বসছিলাম, আপনিও আসুন"।

"আরে না না"। জামিল হায়দার বেকুবের মত হাসল। "আমি পরে খাব ভাই, আপনি খেয়ে আসুন।"

"খামাখা কেন মিথ্যা বলছেন জামিল ভাই?" আমি মুখে অমায়িক হাসি ধরে রেখেছি। "আপনার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে আপনার দারুণ খিদে পেয়েছে!"

এয়ার জামিল হায়দার লজ্জা ভেঙে এসে আমার সাথে খেতে বসল।

খানিকক্ষণ নিরবে কাটল। জামিল হায়দারই প্রথমে নিরবতা ভাঙল। "একটা প্রশ্ন করি নাজিম ভাই?"

"জি করেন"।

"আপনি এত ভাল একজন মানুষ! ভাবী কীভাবে পারল আপনাকে ছেড়ে যেতে?"

প্রশ্নটা শুনে আমার মুখের ভেতর টেস্টিং লস্ট দিয়ে রান্না করা খাবার হঠাৎ তেঁতো লাগল। আমি উত্তর দিলাম না, একটু হেসে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।

জামিল হায়দার তবুও নাছোড়বান্দা। বলে যাচ্ছে- "এই যে আপনি এখন উত্তরটা এড়িয়ে যেতে চাইছেন! পিওর ভদ্রলোক যাকে বলে! অন্য কেউ হলে বউয়ের নামে এক গাঁদা অভিযোগ ছুড়ে দিত! কিন্তু আপনি তো ভাল মানুষ। আপনি তো কিছুই বলবেন না! বলুন না ভাই? জানতে খুব ইচ্ছে করে! কোন কথা নেই, বার্তা নেই, হঠাৎ আপনার স্ত্রী আপনাকে ফেলে পালিয়ে গেল? কিন্তু কেন?"

আমি প্রমাদ গুনলাম! এর হাত থেকে কতক্ষনে পরিত্রাণ পাব কে জানে? কথাটা এড়াতে বললাম, "এই যে মগজ ভুনাটা নিন জামিল সাহেব! আমার নিজ হাতে রান্না করা। ভাল মজা পাবেন। আর ডালটাও একটু চেখে দেখবেন, জলপাই দেওয়া ডাল, টক টক লাগে, অপূর্ব স্বাদ হয়েছে!"

এর পর আমি নানা প্রসঙ্গে কথা বলে প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু জামিল হায়দার তো তা বুঝতে চাচ্ছে না! সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে! এই লোকটা আমার হাড় জ্বালিয়ে খাচ্ছে! অফিসে সারাদিন কানের কাছে এসে ঘ্যান ঘ্যান প্যান করে! মাঝে মধ্যে আমার মনে হয় তার বুঝি কাজই হচ্ছে মানুষের কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করা! এই জন্যই মাস শেষে অফিস থেকে বেতন পায়। কথা না বলে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে- তাকে এমন অবস্থায় মনে হয়না কেউ কখনও দেখেছে!

অবশেষে বিরক্তির শেষ সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর বললাম- "আপনি শুনতে চান কেন আমার বউ আমাকে ছেড়ে পালিয়েছে?"

জামিল হায়দার জিভে কামড় দিয়ে বলল, "ওমা! ছিঃ ছিঃ পালানোর কথা আসল কোথথেকে? আমি এমনিতেই জিগেস করলাম উনি কই আছে? কবে ফিরবে ইত্যাদি!"

আমি খুব শান্ত মেজাজে বললাম, "পুরোটা শুনবেন নাকি শেষ টুকু?"

"পুরোটাই শুনতে চাই"। আনন্দে জামিল হায়দারের চোখ দুটো চক চক করছে! না জানি কতদিন অপেক্ষা করে আছে সে এই ঘটনা শুনার জন্য! আমাকে উৎসাহ দেয়ার জন্য বলল, “বাই দা ওয়ে! গরুর মগজ ভুনাটা কিন্তু দারুণ হয়েছে খেতে! আর সেই সাথে ডাল! আহ কি অপূর্ব স্বাদ!”

আমি বলতে শুরু করলাম-

এই ফ্ল্যাটটা আমার দাদা কিনেছিলেন। কেনার কিছুদিন পরই দাদা মারা যান। বাবা ছিল তার একমাত্র সন্তান। এর পর এই ফ্ল্যাটে দাদি আর বাবাই শুধু বসবাস করতেন। কিন্তু দাদা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর থেকেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটতে থাকল। ঠিক রাত ১২টা বাজতেই ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে কেমন যেন খস খস আওয়াজ শুনা যায়। মনে হয় কেউ একজন পা টেনে টেনে হেঁটে যাচ্ছে!

“তাই নাকি? এতো সাংঘাতিক ব্যাপার!” জামিল হায়দারের গলায় টিটকারির সুর চিনতে আমার ভুল হলনা। বুঝলাম ভদ্রলোক আমার কথা কিছুই বিশ্বাস করছেন না! তবুও আমি না থেমে বলে যাচ্ছি-

শব্দটা কেমন যেন অদ্ভুত ধরণের! এমনিতে আমরা যখন ভেতরের রুমে থাকি তখন শোনা যায় কিন্তু কেউ একজন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে শব্দটা আর শোনা যায় না! অনেক কিছু করেছেন দাদি, কিন্তু কিছুতেই এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পান নি। কেউ ই যখন এই ব্যাপারে কিছুই করতে পারল না, তখন আমার দাদি একজন জ্যোতিষীর শরণাপন্ন হলেন।

জ্যোতিষী বললেন, “এটা কোন একটা অভিশাপের ফল! তোর পরিবারের ওপর বড় ধরণের কোন অভিশাপ আছে। তোর স্বামীর পরিবারের কেউ একজন সম্ভবত বিরাট বড় কোন অপরাধ করে বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু যার সাথে ঐ অপরাধ করেছিল সে তো মাফ করেনি! তাই তোদের পিছু নিয়েছে এক অশরীরী ছায়া! এই বাসা পাল্টেও কোন লাভ নেই! যেখানেই যাস, এই ছায়া তোদের পিছু নেবে!”

দাদি জিজ্ঞাসা করলেন, “কিন্তু এই অভিশাপ থেকে মুক্তির কি কোন উপায় নেই?”

জ্যোতিষী উপায় বাতলে দিলেন, “তোর ছেলের বিয়ে দিয়ে যখন বাড়িতে বউ আনতে পারবি, তখন এই সমস্যা দূর হবে”।

দাদি এই কথা বিশ্বাস করেছিলেন কি না জানিনা, কিন্তু জ্যোতিষীর কথা মত কাজ হল। আমার মা যে রাতে এই ফ্ল্যাটে পা রাখলেন, সেদিন থেকে বাড়ির বারান্দায় আর ঐ খস খস শব্দ শোনা গেলনা। দাদি হাফ ছেড়ে বাঁচলেন! অবশেষে বারান্দায় অশরীরী আত্মার হাঁটাহাঁটি বন্ধ করা গেছে। সেই স্বস্তি নিয়েই দাদি মারা গেলেন। কিন্তু বাবার কপালে শান্তি বেশিদিন টিকল না। আমার জন্ম হওয়ার সময় মা মারা গেলেন। ব্যাস! আবার শুরু হয়ে গেল রাত ১২টা বাজতেই বারান্দায় হাঁটাহাঁটি...

আমাকে থামিয়ে দিয়ে জামিল হায়দার বলল, "কিন্তু আপনার এই পারিবারিক ভৌতিক কাহিনীর সাথে ভাবীর পলায়নের যোগসুত্র কোথায়?"

আমি দু সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললাম, “জামিল ভাই, আপনি একটা জিনিস জানেন যে আমি কথার মাঝখানে কথা বলা পছন্দ করিনা। আপনি যদি কথা বলতে চান, বলে যান আমি শুনছি। কিন্তু যদি আমার মুখে কিছু শুনতে চান, দোয়া করে চুপ করে থাকবেন!”

জামিল হায়দার ভাতের লোকমা মুখে দেয়ার ফাঁকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বলল, “ওকে ভাই! বলতে থাকেন! আমি আর বাঁধা দিচ্ছি না!”

আবার শুরু করলাম আমি-

“মায়ের মৃত্যুর পর বাবা আবার সেই জ্যোতিষীর কাছে গেলেন। জ্যোতিষী তখন বুড়ো থুড়থুড়ে হয়ে গেছেন। ঠিক মত কোথাও বলতে পারেন না। আমাকে দেখিয়ে বললেন, ‘তোর ছেলে বড় হয়ে বিয়ে করে যেদিন ঘরে বউ আনবে সেদিন থেকে আবার ঐ অশরীরী আত্মা বিদায় নেবে’। আমি কিন্তু ছোটবেলা থেকে ঐ হাঁটার শব্দ শুনে শুনেই বড় হয়েছি। ব্যাপারটাতে আমি একদমই ভয় পেতাম না। বরং আমার কাছে মজাই লাগত! ভুতের সাথেই যার বসবাস, সে ভুতকে আর কি ভয় পাবে বলুন?” এই পর্যন্ত বলে আমি হো হো হো করে কিছুক্ষন হাসলাম।

জামিল হায়দারও একটু অপ্রস্তুতভাবে হাসল। এখন মনে হচ্ছে আমার কথা খানিকটা বিশ্বাস করছে লোকটা।

যেমন হঠাৎ শুরু করেছিলাম ঠিক তেমনি হঠাৎ করেই হাসি থামিয়ে দিলাম আমি। কয়েক সেকেন্ড বিরতি। জামিল হায়দারের খাওয়া শেষ পর্যায়ে, ঘটনাটা তার আগেই বলে শেষ করা প্রয়োজন! আমি আবার বলা শুরু করলাম-

আমি বড় হলাম, পড়াশুনা শেষ করলাম। একটা ভাল চাকরী পাওয়ার সাথে সাথেই বাবা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য তড়িঘড়ি শুরু করলেন। বিষয়টা আমার ভাল লাগছিল না। আমি আরও সময় নিতে চাইছিলাম সব কিছু গুছিয়ে ওঠার জন্য। কিন্তু বাবা উঠে পড়ে লাগলেন ভুত তাড়ানোর জন্য। জ্যোতিষীর সেই বানী বাবা কখনও ভুলেন নি। আমার স্ত্রী বাড়িতে পা দিলেই বারান্দায় বসবাসকারী ঐ অশরীরী আত্মা নাকি পালাবে!
বাবা ডজনখানেক মেয়ে দেখে অবশেষে সোনিয়াকে পছন্দ করলেন আমার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য। সোনিয়া কে বুঝেছেন তো? আপনার ভাবী!
“জি বুঝেছি”। জামিল হায়দার প্রবলবেগে হ্যা-বোধক মাথা নাড়ল। গল্প ক্লাইমেক্সে পৌঁছেছে দেখে খাওয়া ভুলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
জ্যোতিষীর ভবিষ্যৎবানী আবারও সঠিক প্রমানিত হল! সোনিয়া যে রাতে বাসায় এল সে রাত থেকে ঐ অদ্ভুত খস খস শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। বাবা হাফ ছেলে বাঁচলেন। সোনিয়া নিন্ম-মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধাসিধে মেয়ে। খুব বেশি চাহিদা নেই তার। আমার সংসারটাকে অল্প কদিনেই গুছিয়ে নিল। পতিভক্তি, শ্বশুরভক্তি, সংসারসেবা- আদর্শ বাঙালী গৃহবধূ। সংসারে আছে সুখের সকল উপাদান। দারুণ কাটছিল দিনগুলি। সব কিছুই ঠিক ছিল, শুধু একটা জিনিস বাদে!”

এই পর্যন্ত বলে থামলাম আমি। প্রায় সাথে সাথেই জামিল হায়দার প্রশ্ন করল, তার আর শেষটুকু শোনার তর সইছে না। “কি জিনিস নাজিম ভাই? কি ঠিক ছিলনা?”

“বলছি জামিল ভাই, একটু সবুর করেন”। বলে আমি এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলাম। ইচ্ছে করেই জামিল হায়দারের উত্তেজনা বাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। মৃদু হেসে বললাম, “সব ঠিক থাকলেও একটা জিনিসের অভাব ছিল বাড়িতে”।

“কিসের অভাব?”

“ঐ পায়ের আওয়াজের অভাব বোধ হচ্ছিল খুব!”

“কি বলছেন আপনি?” অবাক হল জামিল হায়দার। “আপনারাতো সারাজীবন আশা করে এসেছেন যে এক সময় ঐ পায়ের আওয়াজ দূর হয়ে যাবে আপনাদের বাড়ি থেকে। আজ যখন সেটা দূর হয়েছে, তার অভাব বোধ হবে কেন?”

"ভুল বললেন জামিল সাহেব"। আমি মুখের হাসিটা ধরে রেখেছি। "আমার দাদি চাইত ঐ আওয়াজ চলে যাক, বাবাও চাইতেন কিন্তু আমি চাইতাম না!"

"তার মানে?"

আমি বুঝানোর চেষ্টা করলাম- “একবার চিন্তা করে দেখেন জামিল ভাই। আপনি ছোটবেলা থেকে প্রতিনিয়ত পেয়ে অভ্যস্ত এমন একটা জিনিস যদি হঠাৎ আপনার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে কি আপনার ভাল লাগবে? লাগবে না! আমারও লাগত না!”

জামিল হায়দার নাছোড়বান্দার মত বলছে, “কিন্তু সেটা তো ঘটে প্রিয় কোন বস্তুর ক্ষেত্রে! এটা একটা ভয়ের ব্যাপার! সবাই চাইবে এটা দূর হোক!”

“আবার ভুল করছেন আপনি। আমি কিন্তু একবারও বলিনি ঐ শব্দ শুনে আমার ভয় লাগত! আমি প্রতিরাতে ঐ শব্দ শুনে শুনে ঘুমাতাম। আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। অভ্যাস না বলে আসক্তি বলতে পারেন। যেদিন থেকে ঐ আওয়াজ দূর হয়ে গেল, সেদিন থেকে রাতের বেলা আমার আর ঘুম আসত না!”

“তারপর?”

“তারপর আর কি? যে কারনে আওয়াজ আসত না সে কারণ দূর করার চেষ্টা করলাম!”

“এবার বুঝেছি!” উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেল জামিল হায়দার! “এবার বুঝেছি কেন সোনিয়া ভাবীর মত এমন ভাল মানুষ ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন! কষ্টে! আপনি নিশ্চয়ই সোনিয়া ভাবীর ওপর অনেক অত্যাচার করেছেন জাতে উনি পালিয়ে যেতে বাধ্য হন!”

আবার ভুল করছেন মশাই! আমি হাসি মুখে বললাম। “আপনি দয়া করে বসুন, আমি বুঝিয়ে বলছি!”

জামিল হায়দার নিতান্ত অনিছা সত্ত্বেও বসল। রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। আমি বললাম, “আমি কি একবারও বলেছি যে আপনার ভাবী পালিয়ে গেছে?”

“পালায় নি! আপনি তাড়িয়ে দিয়েছেন!”

“কোনটাই ঠিক নয়!”

“তাহলে কি ঠিক?”

আমি দার্শনিকের মত বললাম, “হতে পারে সে হয়ত এ বাড়িতেই আছে। অথবা কোথাও নেই!”

“অসম্ভব! আপনার বাড়ি থেকে ভাবীকে ব্যাগ ব্যাগেজ সহ দৌড়ে বেড়িয়ে যেতে দেখা গেছে! সবাই ধরে নিয়েছে ভাবী পালিয়ে গেছেন!

“তাই নাকি? লোকে ধরে নিলেই তা সত্যি হয়ে যাবে?”

“লোকে মিথ্যা ধরবে কেন?”

আমি কৌতুক বলার মত করে বললাম, “আপনি যে মগজভুনা দিয়ে মজা করে ভাত খাচ্ছেন, আমি তো একবারও বলিনি যে ওটা গরুর মগজ ভুনা! কিন্তু আপনি তো ঠিক তাই ধরে নিয়েছেন! তাই বলে কি তাই সত্যি?

আমার দিকে এক মুহূর্ত নিশ্চুপ থাকিয়ে থাকল জামিল হায়দার! তারপর মুখ খুলল, তোতলাচ্ছে- “তা... তারমানে? এ... এই মগজ কিসের? গ... গরুর মগজ তো খেতে এমন হয় না!”

আমি মুচকি হেসে বললাম, “আপনার ভাবীর গুনের কোন শেষ নাই জামিল ভাই! আজ আরও একটা গুন আবিষ্কার করলাম আমরা দুজনে মিলে! কি বলেন?”

জামিল সাহেব চেয়ার ঠেলে উঠে দাড়ালেন, মুখটা রক্তশুন্য ফ্যাঁকাসে দেখাচ্ছে। চোখ মুখ কুঁচকে চেহারায় অদ্ভুত এক বিকৃত ভাব। ভেতর থেকে ঠেলে আসা বমি অনেক কষ্টে আটকানোর চেষ্টা করলে যেমন হয়! এরই ফাঁকে বলতে থাকলেন, “আ... আপনি একটা স্যাডিস্ট! আ... আপনি একটা সাইকো! আ... আমি বলে দেব! স... সব বলে দেব! পুলিশকে সব কিছু বলে দেব!”

“তাই নাকি? সব বলে দেবেন?” আমার চোখে কৌতুক খেলা করছে।

“হ্যা হ্যা বলে দেব!”

আমি টেবিলের ওপর রাখা ফল কাঁটার ছুড়িটা হাতে তুলে নিলাম। এক হাতে ছুরিটার ধার পরিক্ষা করছি। যদিও ফল কাঁটার ছুড়ি, কিন্তু চাইলে এটা দিয়ে অনেক কিছুই করা যায়! জামিল হায়দার আমার দিকে

আতংকিত চোখে তাকিয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম-
“জামিল সাহেব? আপনি কি এখানে আসার আগে কাউকে বলে এসেছেন?”

জামিল হায়দারের মুখটা রক্তশূন্য ফ্যাঁকাসে আকার ধারণ করল। চোখদুটো
বলছে- সে এখানে আসার আগে কাউকে বলে আসেনি!

“আপনি এত ভয় পাচ্ছেন কেন জামিল ভাই?” আমি ছুরিটা আবার টেবিলের উপর নামিয়ে রাখলাম। মুখে সপ্রতিভ হাসি। বললাম, “আপনি পুলিশকে কি বলে দেবেন? বলার মত এখানে আছে টা কি?”

জামিল হায়দারের চোখ মুখ একটু উজ্জ্বল হল এবার! “আপনি এতক্ষন আমার সাথে মশকরা করেছেন তাইনা নাজিম ভাই?”

আমি কিছু না বলে ঠোঁট টিপে হাসছি। মৌনতাই সম্মতির লক্ষন!

জামিল হায়দার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। “ওহ! নাজিম ভাই! আপনি পারেনও! ভয়ে জান উড়ে গিয়েছিল আমার”! জামিল হায়দার আবার পায়ে
পায়ে হেঁটে এসে চেয়ার টেনে বসল। “এটা ঠিক যে আমি আপনাকে সব সময় এটা ওটা প্রশ্ন করে জ্বালাই। তাই বলে এভাবে ভয় দেখাবেন আমাকে?”

আমি মুখে হাসিটা ধরে রেখেছি।

আরও কয়েক সেকেন্ড কেটে গেল।

তারপর...

ঘড়িতে বাজে ঠিক ১২টা!

ঠিক এসময় মত বারান্দা থেকে ঐ খস খস শব্দটা আবার ভেসে এল, কেউ যেন পা টেনে টেনে হাঁটছে। আহ! বড় শান্তি লাগে এই শব্দ শুনতে পেলে!
আমি আবার ফল কাঁটার ছুরিটা হাতে নিলাম। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি জামিল হায়দারের দিকে। আমার চোখদুটো এখন অদ্ভুত এক আনন্দ লাভের আশায় চক চক করছে!

জামিল হায়দার আবারও ভুল করেছে! মৌনতাকে সব সময় সম্মতির লক্ষন ধরে নেয়া ঠিক নয়!

(সমাপ্ত)
1 like ·   •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 30, 2015 22:38
No comments have been added yet.


গুডরিডস ব্লগ

Nazim Ud Daula
এই ব্লগে নাজিম উদ দৌলার লেখা ছোট গল্পগুলো পড়তে পাওয়া যাবে।
Follow Nazim Ud Daula's blog with rss.